ব্লাক ওয়াটার বায়োটোপ

fishkeeping simplified

ব্লাক ওয়াটার বায়োটোপ

আমাদের অ্যাকোয়ারিয়ামে মাছ পোষার শখে নবতম ও তর্কসাপেক্ষে কঠিনতম শাখাটির নাম বায়োটোপ মেকিং, বা অ্যাকোয়ারিয়ামে বায়োটোপ তৈরি। হঠাৎ করে বায়োটোপ শব্দটি শুনলে অনেকেই হয়তো ভাবতে পারেন এ আবার কি জিনিস! তাদের এই বিস্ময়ের কারণ অনুসন্ধান করতে আমাদের ফিরে যেতে হবে সেই স্কুলে পড়ার সময়ে পাঠ্যবইয়ে। যেখানে বলা হয়েছিল A Biotope is an geographical area of uniform environmental conditions providing a living place for a specific assemblage of plants and animals. অর্থাৎ এমন একটি নির্দিষ্ট জায়গা যেখানে নির্দিষ্ট পরিবেশে নির্দিষ্ট জীবের বৃদ্ধি-বিকাশ লাভ হয়। এবং অ্যাকোয়ারিয়ামের ছোট্ট পরিসরে সেই নির্দিষ্ট পরিবেশ সৃষ্টিই একটি কঠিন চ্যালেঞ্জ।

এবার আসি ব্লাক ওয়াটার বা কালো জলের কথায়। সকাল সকাল চিনি, দুধ ছাড়া লিকার চা খেয়ে যাঁদের দিন শুরু হয় তাদের কাছে যদি বলা হয় ওই লিকার চায়ের মতো কালো তিতকুটে জলে যদি মাছ ছেড়ে দেওয়া হয় তবে কেমন হবে? অনেকেই হয়তো বিস্মিত হয়ে যাবেন, অনেকেই হয়তো ব্যাপারটা হেসে উড়িয়ে দেবেন, কিন্তু প্রকৃতিতে ওই রকম কালো জলেই কিছু জীব বসবাস করে। দেখা যায় পৃথিবীর গহীন অরন্য গুলির অন্তরতম স্থল হতে যে সব নদীর সৃষ্টি হয় তাদের জল ওই রকম ঘন কালচে বাদামী। কারণ ওই সব নদীর প্রবাহপথে যে বিপুল উদ্ভিদরাজি থাকে তাদের পাতা, ফল, ফুল ,কান্ড, ক্রমাগতভাবে ঐ নদীগুলির জলেই পতিত হয়। এবং সেগুলি পচে যে জৈব অ্যাসিড তথা ট্যানিন নির্গত হয় তার প্রভাবেই জল হয়ে ওঠে তিতকুটে কালচে ও আম্লিক। যে জলে সূর্যের আলো প্রবেশ করে খুব কম, জলে অক্সিজেনের মাত্রা থাকে বেশ কম (কিছু কিছু ব্যতিক্রম বাদ রেখে), এবং পুষ্টি উপাদানের পরিমাণ থাকে নগন্য। এককথায় জীবন ধারণের জন্য খুবই অনুপোযোগী। তবুও দেখা যায় প্রকৃতির অদ্ভুত খেয়ালে এখানেই বিকাশ ঘটে অসংখ্য জীবনের। অদ্ভুত অদ্ভুত সব বিবর্তন পক্রিয়ার মাধ্যমে প্রতিকূল পরিবেশকে তারা করে নেয় নিজেদের অনুকূল। সেই রকম একটা পরিবেশকে কাঁচের বাক্সে আমাদের বসার ঘরে এনে ফেলার চেষ্টা করতেই আমাদের আজকের এই পোস্ট।

পৃথিবীতে যে সকল নদী দেখা যায় তাদের জলের রঙের উপর ভিত্তি করে ১৮৫৩ সালে বিজ্ঞানী আলফ্রেড রাসেল ওয়ালেস তাদের তিনটি ভাগে ভাগ করেন, ১) স্বচ্ছ জলের নদী, ২) ঘোলাটে বা সাদা জলের নদী এবং ৩) কালো জলের নদী।

ব্লাক ওয়াটারের প্রকারভেদ:প্রকৃতিগত ভাবে ব্লাক ওয়টার দুই ভাগে বিভক্ত-

ক) প্রবহমান কালো জলের নদীনালা : মূলত পৃথিবীর নিরক্ষীয় অঞ্চলে বৃষ্টিবহুল এলাকা গুলিতে, যেখানে গহীন ক্রান্তীয় বৃষ্টি অরন্য অবস্থান করছে সেখানেই এই ধরনের কালো জলের নদী দেখা যায়। এই নদী গুলি ধীর গতির স্রোতস্বিনী। সারাবছর ধরে বৃষ্টির জলে পুষ্ট, এবং অরন্যের জৈব পদার্থ সমৃদ্ধ। এই সব অঞ্চলে সারাবছর উষ্ণতা বেশি থাকে বলে জৈব পদার্থের বিয়োজন হার খুব বেশি ফলে দ্রুত জলে জৈব যৌগ মিশে যায়, এবং জল ট্যানিন সমৃদ্ধ হয়ে কালচে বাদামী হয়ে যায়। আম্লিক বৃষ্টির জলের সাথে জৈব অ্যাসিড মিশ্রিত হয়ে জলের অম্লত্ব খুব কমে যায়, কখনো কখনো তা প্রায় ৪-৪.৫ pH মানের কাছাকাছি নেমে আসে, জলের TDS ৫০-১০০ ppm বা তার থেকেও কমের মধ্যে ঘোরাফেরা করে,তাই আক্ষরিক অর্থেই একে Soft Water rivers ও বলে । এই জলে বসবাসকারী ছোট মাছেরা সাধারণত দল বেঁধে বসবাস করে, এবং দৃশ্যমানতা খুব কম হওয়ায় একে অপরকে চেনার জন্য উজ্জ্বল রং বিশিষ্ট হয়ে থাকে । উদাহরণস্বরূপ নিয়ন, কার্ডিনাল,রামি নোজ টেট্রা; রেমিরেজি, অ্যাপিস্টোগ্রামা প্রভৃতি সিকলিড এর উদাহরণ। দক্ষিণ আমেরিকার রিও নেগ্রো, কারুয়া, আফ্রিকার কঙ্গো প্রভৃতি পৃথিবী বিখ্যাত কিছু ব্লাক ওয়াটার নদী।

খ) স্থির কালো জলের জলাশয় : মূলত দক্ষিণ ও দক্ষিণ পূর্ব এশিয়ায় যেখানে মৌসুমী বায়ুর প্রভাবে Periodical Rainfall হয় সেখানেই মূলত স্থায়ী বা অস্থায়ী ভাবে এই ধরনের জলাশয় সৃষ্টি হয়। উপক্রান্তীয় অঞ্চলে সারা বছরের ৭০-৮০% বৃষ্টিপাত শুধুমাত্র মৌসুমী ঋতুতে হয়ে থাকে। বছরের বাকি সময় প্রায় বৃষ্টিহীন শুকনো থাকে। বৃষ্টির মরশুমে অতিবৃষ্টির ফলে নদীর জল নদীখাত ছাপিয়ে আশেপাশের নিচুভূমি, জলাশয় ইত্যাদিতে প্রবেশ করে এবং সেই সাথে বিভিন্ন ধরনের মাছ সেখানে নতুন ভাবে বসতি গড়ে তোলে। কিন্তু বর্ষা শেষ হয়ে গেলেই ধীরে ধীরে জলস্তর নামতে থাকে এবং ক্রমান্বয়ে নদী তীরবর্তী জলাভূমি গুলি মূল নদী থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে। কিন্তু তাই বলে জলাশয় গুলিতে জৈব পদার্থের যোগান থেমে থাকে না। সারাবছর ধরে বিভিন্ন গাছের পাতা, কান্ড, ফল, ফুল ঐ আবদ্ধ জলাশয়ের জলে পড়তে থাকে ও পচতে থাকে এবং একই সাথে জলাশয় ধীরে ধীরে শুকোতে থাকে। ফলে খুব দ্রুত জলাশয়ের জলের pH কমতে থাকে, কিন্তু TDS বাড়তে থাকে। এমন অবস্থায় বেশিরভাগ জলজ উদ্ভিদ ও প্রানী মারা পড়ে, কিন্তু কিছু কিছু মাছ যেমন খলসে, চ্যাং,মাগুর প্রজাতির মাছেরা তাদের বাতাস থেকে অক্সিজেন গ্রহণ করার বিশেষ ক্ষমতাবলে পরবর্তী বৃষ্টির মরশুম পর্যন্ত টিকে থাকে। কিছু ভাসমান উদ্ভিদ যেমন ক্ষুদি পানা, গোলাপ পানা, ইঁদুরকাণি পানা, ও প্রেথিত মূলি ভাসমান গাছ যেমন পদ্ম, শালুক, মাখনা প্রভৃতি এই বাস্তুতন্ত্রে টিকে থাকে। লক্ষনীয় বিষয় হল এই ধরনের বায়োটোপে জলের pH ৫ মাত্রার কাছাকাছি নেমে গেলেও TDS নিরক্ষীয় অঞ্চলের কালো জলের নদীর মতো অতোটা কমে যায় না, সাধারণত ২৫০-৩০০ কাছাকাছি অবস্থান করে। দীর্ঘ পর্যবেক্ষণে দেখা গেছে শুস্ক ঋতুতে Ground Water Seepage এর একটা বড় কারণ।

বাড়িতে ব্লাক ওয়াটার বায়োটোপএই পর্যন্ত পড়ে অনেক পাঠকেরই মনে হতে পারে বাড়িতে এক টুকরো রিও নেগ্রো বা দক্ষিণ এশিয়ার জলাশয় থাকলে মন্দ হয় না, তাদের উদ্দেশ্যে বলি, এ বিষয়ে বিস্তর পড়াশোনা ও গবেষণার জন্য ইউটিউব ও বিভিন্ন অনলাইন ফোরামে হাজার হাজার ডকুমেন্ট বিদ্যমান। কিভাবে কি করতে হবে তা নিয়ে পুঙ্খানুপুঙ্খ আলোচনা সেখানে করা হয়েছে তাই একটু কষ্ট করে সেখানে খুঁজলেই যেহেতু সে সব পাওয়া যাবে তাই আর সেই প্রসঙ্গে না গিয়ে বরং ব্লাক ওয়াটার বায়োটোপ ঠিকঠাক ভাবে তৈরি করতে কি কি বিষয়ে মেনে চলা উচিত সে প্রসঙ্গে চলে আসি…

১) যে কোন বায়োটোপ সবসময় সুনির্দিষ্ট এলাকা ভিত্তিক হতে হবে। উদাহরণস্বরূপ বলা যায় আমাজন নদী এত দীর্ঘ যে তার প্রবাহপথের এক অংশের সাথে অন্য অংশের আকাশ পাতাল পার্থক্য রয়েছে। তাই আমাজন বায়োটোপ বলে কোন বায়োটোপ হয় না, তাই আমাজনের ঠিক কোন অংশের আপনি অনুকরণ করছেন তার বিস্তারিত তথ্য এক্ষেত্রে খুব গুরুত্বপূর্ণ।

২) বায়োটোপ মানেই প্রাকৃতিক পরিবেশের সাথে আপনার অ্যাকোয়ারিয়ামের পরিবেশের পুঙ্খানুপুঙ্খ মিল।

৩) বায়োটোপে বায়োলজিক্যাল ফিল্ট্রেশনের ভূমিকা অপরিসীম। বায়োটোপকে ইকোস্ফিয়ারে পরিনত করাই একজন সফল বায়োটোপ নির্মাতা লক্ষ হওয়া উচিত।

৪) বায়োটোপ এমন একটি অবস্থা যেখানে পরিবেশ খুব দ্রুত বদল হয় না, তাই আপনার অ্যাকোয়ারিয়ামটিও যাতে যথেষ্ট স্টেবল হয় সেই বিষয়ে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিতে হবে। কারণ বায়োটোপ মানেই স্টেবিলিটি।

৫) বিভিন্ন রাসায়নিক পদার্থ, অধিক বায়োলোড ইত্যাদি না থাকাই বাঞ্ছনীয়। হাইব্রিড, ট্যাঙ্কব্রিড, জেনেটিক্যালি মডিফাইড প্রজাতি বায়োটোপে না রাখাই উচিত।

বায়োটোপ নির্মাণ মানেই ধৈর্য আর গবেষণার খেলা তাই আর দেরি না লেগে পড়তেই পারেন এই কাজে। আমাদের তরফ থেকে আগাম শুভেচ্ছা রইল।

 

We are accepting the entries for IBAC

X