Aggression in Fish tank
রঙিন মাছের আগ্রাসন (Aggressiveness)
===============================
আজকাল দেশি বিদেশি রঙিন মাছের সমাগমে আমাদের মাছ পোষার শখ বেশ আন্তর্জাতিক হয়ে উঠেছে । ঘরে ঘরে আফ্রিকান, সেন্ট্রাল আমেরিকান, দক্ষিণ আমেরিকান মাছের ট্যাঙ্ক দেখা পাওয়া যাচ্ছে । সেই সাথে এসেছে নিত্য নতুন সমস্যা । এর মধ্য একটি প্রধান সমস্যা মাছের Aggression , যা নিয়ন্ত্রণ করতে নতুন তো বটেই পুরোনো hobbyist দেরও অনেক সময় হিমসিম খেতে হচ্ছে । মাছ আহত বা নিহত হওয়া লেগেই আছে । মারামারির ভয়ে অনেকেরই ইচ্ছা সত্বেও পছন্দের মাছ পোষা হয়ে উঠেছে না । এমতাবস্থায় সমস্যাটি একটু তলিয়ে দেখতেই এই লেখালিখি ….
মাছের আগ্রাসন আটকানোর জন্য কয়েকটি প্রশ্নের উত্তর জানা খুব গুরুত্বপূর্ণ,
[১] মাছের আগ্রাসন কি?
যখন কোন নির্দিষ্ট কারণে এবং উদ্দেশ্যে কোন মাছ তার সাথে বসবাসকারী অন্য মাছকে আক্রমণ করে তখন তাকে আমরা Fish aggression বলি । বেশিরভাগ সময়ই aggression physical হয় না, শুধুমাত্র ভীতি প্রদর্শনের মাধ্যমে একে অপরকে দূরে সরানোই এর উদ্দেশ্য থাকে। কিন্তু পরিবেশ পরিস্থিতি ভেদে কখনো কখনো তা প্রাণঘাতী হয়ে দাঁড়ায় । দেখা যায় মাছের আগ্রাসন দুই ভাবে হয় –
ক] অন্তঃপ্রজাতি আগ্রাসন: যখন কোন নির্দিষ্ট প্রজাতির মাছ তার নিজের প্রজাতির মাছেদের প্রতি আগ্রাসন দেখায় তাকে অন্তঃপ্রজাতি আগ্রাসন বলে । যেমন ব্রিডিং সিজনে একটি পুরুষ গোরামী অন্য পুরুষ গোরামীকে আক্রমণ করে। অথবা একটি পুরুষ ফাইটার অন্য পুরুষ ফাইটার দেখলেই আক্রমণ করে ।
খ] আন্তঃপ্রজাতি আগ্রাসন: যখন একটি নির্দিষ্ট প্রজাতির মাছ অন্য প্রজাতির মাছেদের প্রতি আগ্রাসন দেখায় তখন তাকে আন্তঃপ্রজাতি আগ্রাসন বলে। উদাহরণ হিসেবে বলা যায় আফ্রিকান সিচলিড বা আমেরিকান সিচলিডরা তাদের ট্যাঙ্কে রাখা যে কোন মাছকেই আক্রমণ করে ।
[২] কিভাবে বুঝবেন আপনার অ্যাকোয়ারিয়ামে মাছেদের মধ্যে আগ্রাসন হচ্ছে?
অ] অ্যাকোয়ারিয়ামে দুর্বল, আকারে ছোট বা তুলনামূলক শান্ত মাছেদের শারীরিক ক্ষতি হবে । শক্তিশালী মাছের আক্রমণে কারোর লেজ বা পাখনা ছেঁড়া থাকতে পারে। আঁশ উঠে যেতে পারে । মুখের কাছে লালচে দাগ থাকতে পারে ।
আ] আক্রান্ত মাছটি ট্যাঙ্কের কোনায়, ফিল্টারের পিছনে বা জলের উপরের দিকে আশ্রয় নিতে চাইবে । ভয়ে মাছটি পাখনা চুপসে রাখবে ।
ই] আক্রান্ত মাছ খাওয়া দাওয়া বন্ধ করে দিতে পারে , সেক্ষেত্রে ধীরে ধীরে দুর্বল হয়ে পড়বে ও গায়ের রং অনুজ্জল হয়ে যাবে ।
ঈ] শক্তিশালী মাছটি দুর্বল মাছটিকে বেশিরভাগ সময় ধাওয়া করতে চাইবে ।
উ] আক্রান্ত মাছটির ট্যাঙ্ক থেকে লাফিয়ে পড়ার সম্ভাবনা দেখা দেবে ।
[৩] আগ্রাসনের কারণ কি?
অ্যাকোয়ারিয়ামে মাছের আগ্রাসন ঠেকানোর একমাত্র উপায় কি কারণে মাছ আগ্রাসন দেখাচ্ছে সেটা জানা। যদি কারনটা সঠিক ভাবে নির্ণয় করা যায় তবেই আগ্রাসন বন্ধ করা সম্ভব, নচেত্ নয় । তাই চলুন দেখে নিই মাছ কেন আগ্রাসন দেখায় –
ক] এলাকা দখল ও রক্ষা: বিভিন্ন মাছ তার প্রাকৃতিক পরিবেশ নির্দিষ্ট একটি জায়গা দখল করে স্থায়ী বা অস্থায়ী ভাবে বসবাস করে। এই জায়গাটিকে ওই মাছের টেরিটোরি বা দখলকৃত এলাকা বলে। দেখা যায় জলের নীচে পড়ে থাকা কাঠের গুঁড়ি, পাথরের খন্ড ইত্যাদিকে ব্যবহার করে এই বাসা গড়ে ওঠে। এবং মাছেরা এখনে অন্য কাউকে সহজে ভিড়তে দেয় না । অন্য কোন মাছকে তাঁর বাসার কাছাকাছি দেখলেই মারতে তেড়ে যায় । এবার ভাবুন আপনার অ্যাকোয়ারিয়ামের ছোট জায়গায় যদি এমন কোন মাছ রাখেন যে বাসা বানাতে ওস্তাদ তবে কি হবে ?
খ] প্রজনন: মাছেরা শুধুমাত্র বাসা বানিয়ে বসবাস করে না সেখানে ডিম পেড়ে নতুন প্রজন্মের সুত্রপাত ঘটায়। ব্রিডিং সিজনে বহু প্রজাতির মাছ দম্পতিকে দেখা যায় ডিম ও ছানাদের রক্ষা করতে। আপনার অ্যাকোয়ারিয়ামে যদি এরকম কোন ঘটনা ঘটে তবে অ্যাকোয়ারিয়ামে বসবাসকারী অন্য মাছেরা সেই মাছ দম্পতির কাছে মার খেতে পারে।
গ] সঙ্গী নির্বাচন: বংশবৃদ্ধির জন্য সঙ্গী নির্বাচন একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রক্রিয়া । পৃথিবীর বেশিরভাগ জীবের মতোই মাছেদেরও প্রজনন ঋতুতে সঙ্গী বাছতে হয় । এবং এই সময় সঙ্গিনীর কাছে গুরুত্ব পাওয়ার জন্য পুরুষ মাছেদের একে অন্যের সাথে মারামারি করতে দেখা যায় । প্রকৃতিতে বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই মারামারি প্রাণঘাতী না হলেও অ্যাকোয়ারিয়ামের ছোট পরিবেশ তা প্রায়শই প্রাণঘাতী হয়ে দাঁড়ায় । কোন একটি বা দুটি ছোট বা তুলনামূলক ভাবে দুর্বল মাছ টার্গেট হয়ে গেলে অচিরেই তাদের মৃত্যু হয় ।
ঘ ] খাদ্য: খাদ্যের জন্য প্রতিযোগিতা একটা আপাত নির্বিবাদী মাছকেও আক্রমণাত্মক করে তুলতে পারে । অ্যাকোয়ারিয়ামে খাদ্যের অভাব হলে বা খাদ্য অনিয়মিত হলে বড় মাছগুলি ছোট ছোট মাছেদের প্রতি আগ্রাসন দেখাতে থাকে ।
ঙ] Bioload: কোন একটি নির্দিষ্ট জায়গায় যতগুলি মাছ থাকতে পারে তারচেয়ে বেশি মাছ রাখলে মাছেদের স্ট্রেস বৃদ্ধি পায় । ফলে একে অপরের প্রতি আক্রমণাত্মক হয়ে পড়ে । প্রসঙ্গত বলি, আমেরিকার বা আফ্রিকান সিচলিডের ক্ষেত্রে অনেকেই ভাবেন Overstock করে Aggression কমিয়ে ফেলবেন বাস্তবে এটি সম্পূর্ণ ভুল ধারণা । কারণ Overstocking পারস্পরিক আগ্রাসন কমালেও ট্যাঙ্কের Overall aggression বাড়িয়ে দেয় ।
চ] আহত মাছ : অনেক ক্ষেত্রেই দেখা যায়, অ্যাকোয়ারিয়ামে দীর্ঘদিন বসবাসকারী কোন মাছ হঠাত্ করে আঘাতপ্রাপ্ত হলে নিজেও খুব Aggressive হয়ে যায় । এক্ষেত্রে ওই মাছটি নিজেকে সুরক্ষীত রাখতে “Attack is the best form of defence” মনে করে ।
ছ] স্বভাব: কোন কোন মাছ প্রকৃতিগত ভাবেই তাঁরা যে কোন অবস্থাতেই আগ্রাসন দেখায়। গুঞ্চ, রেডটেল ক্যাটফিশ, মালাউই সিচলিড, উলফ ফিশ প্রভৃতি এর উদাহরণ ।
[৪] কিভাবে আগ্রাসন আটকানো যাবে ?
আগ্রাসন আটকানোর মূলমন্ত্র হল “precaution is better than cure” অর্থাত্ আগে থেকে ব্যবস্থা নিলে আগ্রাসন আটকানো সম্ভব । এক্ষেত্রে কতগুলো ব্যবস্থা গ্রহণ খুব জরুরী-
ক] যতটা সম্ভব বড় অ্যাকোয়ারিয়াম তৈরি করা দরকার। এতে মাছেরা তাদের personal space ধরে রাখতে পারে। একে অন্যের টেরিটোরিতে প্রবেশ করে না । ফলে অ্যাকোয়ারিয়ামে শান্তিপূর্ণ পরিবেশ বজায় থাকে । উদাহরণ হিসেবে বলা যায় একটি মবুনা ট্যাঙ্ক নূন্যতম 100 লিটারের , পিকক ট্যাঙ্ক 150-200 লিটারের এবং হ্যাপ ট্যাঙ্ক 300 লিটারের কাছাকাছি হওয়া উচিত ।
খ ] Species Only tank হলে সবচেয়ে ভালো হয় । অ্যাকোয়ারিয়ামে একটি প্রজাতির মাছ রাখাই সবচেয়ে ভালো পদ্ধতি । এতে যেমন মাছের সঠিক আচার আচরণ প্রকাশ পায়, তেমনি আক্রমণাত্মক আচরণও অনেকটাই নিয়ন্ত্রণে রাখা যায় । উদাহরণ হিসেবে বলা যায় অনেকেই একই ট্যাঙ্কে আফ্রিকান ও আমেরিকান সিচলিড ভুলবশত রেখে ফেলেন । কিন্তু একটি নির্দিষ্ট সময় পরে তাদের মধ্যে ভয়ঙ্কর আগ্রাসন শুরু হয়ে যেতে পারে ।
গ] যদি একান্তভাবেই কমিউনিটি ট্যাঙ্ক করার ইচ্ছা থাকে তবে একাধিক মাছ পোষার আগে কোন মাছ কোন মাছের সাথে থাকে ভালোভাবে জেনে নেওয়া দরকার । উদাহরণ হিসেবে বলা যায় কার্ডিনাল ও নিয়ন টেট্রা সহজেই একসাথে থাকলেও প্যারাডাইস ও ডোয়ার্ফ গোরামী একসাথে থাকে না, ইত্যাদি ।
ঘ] অ্যাকোয়ারিয়ামে মাছেদের লুকিয়ে থাকার জন্য প্রচুর hiding spots রাখা ভীষণ জরুরী । এক্ষেত্রে হঠাত্ কোন মাছ আগ্রাসী হয়ে উঠলে অনন্য মাছ গুলি লুকিয়ে থেকে জীবন রক্ষা করতে পারে ।
ঙ] আইসোলেশন বা বিচ্ছিন্ন করে রাখা । অ্যাকোয়ারিয়ামে কোন মাছ কোন কারণে ভীষণ আগ্রাসন দেখালে তাকে আলাদা অ্যাকোয়ারিয়ামে কিছুদিন আলাদা করে রাখা হয় । এটি আগ্রাসন আটকানোর একটি বহুল প্রচলিত পদ্ধতি হলেও জেনে রাখা দরকার সঠিক ভাবে পদ্ধতি টি অবলম্বন না করতে পারলে কিন্তু কাজের কাজ হওয়া মুশকিল । এক্ষেত্রে মাছটিকে তার পুরোনো ট্যাঙ্ক থেকে যতো সম্ভব দূরে সরিয়ে রাখা উচিত । কালো/সাদা কাপড় দিয়ে ঢেকে রাখলে ভালো হয়। কারণ অন্য পরিবেশে রাখলে মাছটি দ্রুত তার পুরোনো পরিবেশ ভুলে যায়। এবং তারপর পুরোনো অ্যাকোয়ারিয়ামে ছাড়ালে aggression কমে যায়।
চ] জল পরিবর্তন । এই পদ্ধতিটিও কিছু কিছু মাছের ক্ষেত্রে বেশ কার্যকর । বিশেষত যাঁরা আফ্রিকান সিচলিডে পোষেন । জল পরিবর্তন করে তাদের পুরোনো টেরিটোরি মার্ক কিছুটা মুছে ফেলা যায়, সেক্ষেত্রে সাময়িক ভাবে কিছুটা aggressiveness কমে।
ছ] Bare bottoms ট্যাঙ্ক । ট্যাঙ্কে কোন substrate, পাথর বা ডালপালা না থাকলে মাছ সহজে টেরিটোরি মার্ক করতে পারে না । ফলে টেরিটোরি রক্ষা করতে গিয়ে মারামারিও কমে যায়।
জ] বড় অ্যাকোয়ারিয়ামে ঘন উদ্ভিদ থাকলে অনেক সময় তা বহু মাছকে লুকিয়ে থাকতে সাহায্য করে । ইলোডিয়া, বোতলব্রাশ, ভ্যালিসনেরিয়া, স্যালভিনিয়া, ফ্রগবিটস ইত্যাদি উদ্ভিদ এই ক্ষেত্রে খুব কার্যকরী ।
ঝ] লিঙ্গ অনুপাত ঠিক রেখে মাছ পুষলে অনেক সময় সহজেই মারামারি এড়ানো যায় । উদাহরণ হিসেবে বলা যায় একটা অ্যাকোয়ারিয়ামে একটা পুরুষ গোরামি পিছু ২-৩ টি স্ত্রী গোরামী রাখা যায় কিন্তু কখনোই একাধিক স্ত্রী গোরামি থাকলো একাধিক পুরুষ রাখা উচিত নয় ।
ঞ] অ্যাকোয়ারিয়ামে শুধু পুরুষ বা শুধু স্ত্রী মাছ রাখলেও আগ্রাসন কমে । যেমন আফ্রিকান সিচলিডের ক্ষেত্রে শুধুমাত্র উজ্জ্বল রঙের পুরুষ মাছ রাখার চল আছে । এর সুবিধা হলো ব্রিডিং এর কারণে কোন মাছ আগ্রাসী হয়ে যায় না।
এছাড়াও নিয়মিত যত্ন নেওয়া, সময় মতো খেতে দেওয়া, সারা বছর একই রকম তাপমাত্রা ধরে রাখা ইত্যাদি ব্যপার গুলোর প্রতি একটু যত্নশীল হলে সহজেই মাছেদের বিবাদ-মিমাংশা করা যায় ।
পরিশেষে বলি , মাছ কেনার সময় কি মাছ কিনছেন সে বিষয়ে সতর্ক থাকুন । দরকার হলে সেই মাছ সম্পর্কে যথেষ্ট পড়াশোনা করে নিন এবং স্বভাব চরিত্র বুঝে তারপর মাছ কিনুন । আগ্রাসন মাছের স্বাভাবিক প্রবৃত্তি । একে সম্পূর্ণ নিরসন করা অসম্ভব । তাই যদি অ্যাকোয়ারিয়ামে সামান্য আগ্রাসন হয় তবে অযথা আতঙ্কিত না হয়ে মাছেদের আচার আচরণ খুঁটিয়ে লক্ষ্য করুন । কি কারণে আগ্রাসন হচ্ছে সেটা খুঁজে বার করে, প্রয়োজন অনুযায়ী ব্যবস্থা নিন । ধন্যবাদ ।