Balantiocheilos melanopterus (silver shark)
অ্যাকোয়ারিয়ামে রূপালী হাঙর
সময়টা নব্বইয়ের দশকের শুরুর দিক। বাবার হাত ধরে দাঁড়িয়ে আছি রেল স্টেশনের ওপর ছোট্ট মাছের দোকানটায়। ততদিনে একটা অ্যাকোয়ারিয়াম হয়েছে। লোহার ফ্রেম বাঁধানো চারফুটের পেল্লাই ট্যাঙ্ক। সেটার জন্যই পছন্দ করে মাছ কিনতে আসা। এখন বুঝি আমার থেকে বাবার উৎসাহ কিছুমাত্র কম ছিল না। ওই ছোট্ট দোকানে কোনো নতুন মাছ এলেই আমাকে নিয়ে হাজির হয়ে যেত। সেখানেই প্রথম দেখা রূপালী রঙের ছিপছিপে গড়নের মাছটার সঙ্গে। লেজে আর পাখনায় সুন্দর কালো পাড় বাদ দিলে অনেকটা যেন আমাদের বাটা মাছের বাচ্চা। অ্যাকোয়ারিয়ামের এমাথা থেকে ওমাথা কেমন সুন্দর ঘুরে বেড়াচ্ছে আর তালে তালে কোনাচে পিঠ-পাখনাটা তিড়িক তিড়িক করে নড়ছে। দেখেই পছন্দ হয়ে গেল। আবার নাম নাকি সিলভার শার্ক। একেই রূপালী পাতের মতো ট্যাঙ্কের এমাথা থেকে ওমাথা ঘুরছে, তার ওপর নাকি শার্ক! আর পায় কে! বাড়িতে হাঙর রাখার এই সুযোগ আর ছাড়া যায় নাকি।
সেইদিক থেকে বলতে গেলে একদম হবির শুরুর দিন থেকে সিলভার শার্ক আমার সঙ্গী। এদের ওই কালো ফ্রেমে বাঁধানো মসৃণ রুপালি ঝলকে না মজে উপায় আছে! তবে ওই “শার্ক” নামটা শিহরণ জাগালেও, সেটার কারণ ওনার টর্পেডোসম গড়ন আর ওই ওঁচানো তিনকোনা পিঠপাখনাটা। হাঙরের সাথে যাবতীয় মিল কিন্তু ওখানেই শেষ। আসলে এরা সাইপ্রিনিডি পরিবারের মাছ, আর সেদিক থেকে আমাদের রুই, কাতলা পুঁটির কাছের আত্মীয়। এদের আরেকটা পরিচিত নাম বালা শার্ক, যার উৎস এদের লাতিন নাম Balantiocheilos melanopterus. আবাস ভূমি দক্ষিণ পূর্ব এশিয়ার বিস্তৃত অঞ্চল। অবশ্য এদের নাম-ধাম নিয়ে দারুণ একখানা গল্প আছে। সেটা এইফাঁকে বলে রাখি।
মানচিত্রের দিকে চোখ রাখলে দেখা যাবে ইন্দো-চায়না রিজিয়ন থেকে থাইল্যান্ড, কাম্বোডিয়া, মালয়েশিয়া হয়ে দক্ষিণে নামতে নামতে স্থলভাগ দ্বীপরাষ্ট্র ইন্দোনেশিয়া হয়ে ভারত মহাসাগরে এসে মিশেছে। একসময় মনে করা হত সিলভার শার্কের বিস্তৃতি প্রায় এই গোটা অঞ্চল জুড়ে। কিন্তু ন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি অফ সিঙ্গাপুরের Heok Hee Ng আর সুইস্ মৎস্যবিজ্ঞানী Maurice Kottelat বহুদিনের সংগৃহীত সিলভার শার্কের স্পেসিমেন ঘাঁটাঘাটি করে দেখেন মূল ভুখন্ডের অর্থাৎ এককথায় বললে সেন্ট্রাল থাইল্যান্ডের আসপাশ থেকে সংগৃহীত নমুনাগুলি কেমন যেন আলাদা। পূর্ণাঙ্গ মাছগুলোর মাথাগুলো কেমন যেন ভোঁতা, শ্রোণি আর পায়ু পাখনার কালো পাড়ও তুলনায় সরু। সেসব নমুনা ততদিনে ফর্মালিনে রঙ হারিয়েছে, কিন্তু যা দু’চারটি রঙিন ছবি ছিল তাতেও থাইল্যান্ডের মাছের মাথা ও পিঠে সোনালী আভা স্পষ্ট। অবশ্য এই সোনালী আভার কথা আগেই উল্লেখ করেছিলেন কাম্বোডিয়ার মৎস্য বিশেষজ্ঞ W.J. Rainboth. অবশেষে সব গবেষণার শেষে, 2007 সালে জানা যায় মূল ভূ-খন্ডে পাওয়া সিলভার শার্ক আসলে একটি নতুন প্রজাতি। তার নামকরণ হয় Balantiocheilos ambusticauda. বিগত প্রায় দেড়শো বছর ধরে যে ধারণা প্রচলিত ছিল যে সিলভার শার্ক Balantiocheilos গণের অন্তর্ভুক্ত একমাত্র প্রজাতি বা মনোটাইপিক, সেই ধারণা পরিবর্তিত হয়। সিলভার শার্ক পায় তার নতুন তুতো ভাই। আর আমাদের আলোচ্য B. melanopterus -এর সীমানা নির্ধারিত হয় ইন্দোনেশিয়ার প্রধান দুই দ্বীপ বোর্নিও আর সুমাত্রায়। বোর্নিওর উত্তরের কিছু অংশ মালয়েশিয়ার অন্তর্ভুক্ত আর মধ্য ও দক্ষিণের বেশিরভাগ অংশ, যা কালিমান্তান নামে সুবিদিত তা ইন্দোনেশিয়ার। সেই কালিমান্তান আর সুমাত্রা দ্বীপের বাতাং-হারি নদীর বেসিনকে এখন সিলভার শার্কের আদিভূমি হিসেবে ধরা হয়।
এই এলাকার নদীনালার মিষ্টি জলে একসময় দল বেঁধে ঘুরে বেড়াতে দেখা যেত সিলভার শার্কদের। বর্ষায় ঢুকে পড়তো নদীর আসেপাশের ঝিলে, জলাভূমিতে। যদিও নিজভূমেই এখন এরা পরবাসী। জলদূষণ, দাবানল একাধিকি নদীবাঁধ এবং সর্বোপরি অ্যাকোয়ারিয়াম হবির জন্য নির্বিচারে সংগ্রহ এদেরকে স্বাভাবিক আবাসভূমি থেকে প্রায় নিশ্চিহ্ন করে দিয়েছে। IUCN রেড লিস্টে এদের ঠাঁই হয়েছে Threatened ক্যাটাগরিতে। আমরা যে সব বালা শার্কদের দেখতে পাই অ্যাকোয়ারিয়ামের দোকানে কি কোনো শখের মেছুড়ের ট্যাঙ্কে, তাদের সবারই জন্ম কিন্তু ক্যাপটিভ ব্রিডিং বা কৃত্রিম প্রজননের মাধ্যমে।
চলুন এবার ইন্দোনেশিয়া থেকে অ্যাকোয়ারিয়ামে ফিরে আসি। কিভাবে রাখবেন বালা শার্ক? শুরুতেই জেনে নেওয়া ভালো এরা দল বেঁধে থাকতে ভালোবাসে। সাইজে পৌঁছতে পারে একফুটের কাছাকাছি। খোলা-মেলা পরিষ্কার জলে সাঁতরে বেড়ানো এদের অভ্যাস। তাই প্রথমেই দরকার বড় ট্যাঙ্ক, আর অনেক ফাঁকা জায়গা এদের সাঁতার কাটার জন্য। চারফুট বা তার থেকে লম্বা ট্যাঙ্কের নিচে এদের রাখাই ঠিক নয়। তেমন কোনো ডেকরেশনের ধার ধারে না তবে ভ্যালিসিনেরিয়া জাতীয় গাছপালার সামনে এদের রূপালী ঝলক দেখতে বেশ লাগে। সাবস্ট্রেট হিসেবে নদীর বালি যথেষ্ট। আর লাগে পরিষ্কার স্বচ্ছ জল, তাই খুব খুব ভালো ফিল্ট্রেশন, সাথে সামান্য জলস্রোত। জলের গুণগত মান কমলেই এদের নানারকম অস্বাচ্ছন্দ্য শুরু হতে পারে। তাই ফিল্টার দিন বুঝে। যেহেতু বড় ট্যাঙ্ক তাই sump আর ক্যানিস্তার হল সবথেকে ভালো অপশন। আর টপ ফিল্টার, পাওয়ার ফিল্টার আর স্পঞ্জ ফিল্টারের কম্বিনেশন দিয়ে যদি আপনি ট্যাঙ্ক ফিল্ট্রেশন ম্যানেজ করতে পারেন তবে তো আর কথাই নেই। যথাযথ ফিল্ট্রেশন আর জলের হার্ডনেস মোটামুটি 300 ppm এর মধ্যে, ওদিকে pH 6-8, সিলভার শার্কের চাহিদা সামান্যই। নিরক্ষীয় অঞ্চলের মাছ, তাই বছরের বেশিরভাগ সময় আমাদের অঞ্চলের আবহাওয়ায় এদের সমস্যা হয় না। কিন্তু পারদ 20° সেলসিয়াসের নিচে নামলে থার্মোস্ট্যাট দিতে হতে পারে।
খাবার ব্যপারেও এদের নিয়ে কোনো সমস্যা নেই। ড্রাই ফুড, সবজি সেদ্ধ, পালং সেদ্ধ, কেঁচো, ব্লাড ওয়ার্ম যাই দেওয়া হোক না কেন সোনা মুখ করে খায়। হ্যাঁ তবে সাইজে একটু বড় হয়ে গেলে মুখের সাইজমতো ছোট মাছকে খেয়ে নেওয়ার বদভ্যাস আছে। আদর্শ ট্যাঙ্কমেট হতে পারে ট্রপিকাল অঞ্চলের শান্তশিষ্ট মাঝারি সাইজের মাছেরা। নানা রকমের গোরামি, বোসমনি রেনবোফিশ এমনকি এঞ্জেলের সঙ্গেও এদের বেশ সখ্যতা আছে। সাবস্ট্রেটে পড়া অতিরিক্ত খাবার পরিষ্কারের জন্য কিছু কোরিডোরাস ক্যাটফিশও ছাড়তে পারেন। তবে সবথেকে ভালো হয় সাইজ মতো ট্যাঙ্কে চার থেকে ছ’টা সিলভার শার্ক একসাথে রাখলে।
এদের পুরুষ মহিলা আলাদা করা বেশ মুশকিলের। পূর্ণাঙ্গ পুরুষ সাধারণত সাইজে একটু বড় হয় আর স্ত্রী তুলনায় একটু গোলগাল, নাদুসনুদুস। কিন্তু ছোটবেলায়, মানে যে সাইজের মাছ আমরা হবিতে দেখি সেখানে এই পার্থক্য খোঁজা বৃথা। আর সাধারণত অ্যাকোয়ারিয়ামে এরা ব্রিডিং বিহেভিয়ার দেখায় না, সুতরাং মেল ফিমেল রেশিও নিয়ে মাথা না ঘামানোই ভালো।
তাহলে কি ভাবছেন আপনার চার ফুট কি তার বড় ট্যাঙ্কের জন্য কটা সিলভার শার্ক এনেই দেখবেন নাকি? এখন যদিও নানারকম মাছের ভীড়ে সিলভার শার্ক একটু ব্যাকডেটেড। কিন্তু গ্যারেন্টি দিয়ে বলতে পারি আমার ছোটবেলার রূপালী শো-স্টপার আপনাকে নিরাশ করবে না।