Botia almorhae (YOYO Loach)
তখন আমি সদ্য কলেজে ভর্তি হয়েছি। বাড়ি থেকে কলেজ বেশ দূরে। কলেজ থেকে কনসেসন তুলে বনগাঁ লোকালে ডেইলি প্যাসেঞ্জারি করি। বনগাঁ লোকালের ভীড় ম্যানেজ করা নতুন শিখছি। কিছুটা কনফিডেন্স এসেছে। তাই একদিন কলেজ থেকে ফেরার পথে পাশের রঙিন মাছের দোকানে ঢুকেই পড়লাম। দেখি নতুন একটা মাছ, অনেকটা আমাদের দেশি গুঁতের মতো। রুপোলি গায়ে কালো রঙের টানা টানা দাগ। দোকানদার বললো “ভালো করে খেয়াল করে দেখ গায়ে কি লেখা আছে ” । তখন খেয়াল পড়লো মাছের গায়ে দুটো ইংরাজি শব্দ Y আর O । দেখে তো আমি থ । এই মাছ আমার চাই। দাম হাঁকল কুড়ি টাকা জোড়া, পকেটে তখন ছিল ৩০ টাকা, ৩টে কিনে প্যাক করে বিকেলের বনগাঁ লোকালে গুঁতোগুতি করে উঠে পড়লাম। পিঠে ব্যাগ, একহাতে মাছ, এক হাতে ট্রেনের হ্যান্ডেল । উদোম ভীড়। তারপর গোদের উপর বিষফোঁড়া মাছের প্যাকেট ফুটো। এবার যদি জল পড়ে খিস্তি একটাও মাটিতে পড়বে না। কি করা যায় ভাবতে ভাবতে, দিলাম প্যাকেটটা সিটের নিচে ফেলে, গলি একটু ফাঁকা হলে ভিতরে ঢুকে দেখা যাবে। যাইহোক সেদিন জল-টল পড়ে একেকার কান্ড বাধিয়ে বাড়ি ফিরলাম । ফিরে যখন অ্যাকোয়ারিয়ামে ছাড়তে যাবো তখন আবিস্কার করলাম ও হরি এদের মুখের দুপাশে তো দুটো গজ দাঁত, ঠিক বুনো শুয়োরের মতো। এবার বুঝলাম প্যাকেট ফুটো হলো কেন, লঙ্কাকাণ্ডের হনুমান কে ! তাহলে আশাকরি বুঝেই গেছেন কারা আজকের নায়ক …
সেদিন যাকে এনেছিলাম তাকে কিভাবে রাখতে হয় তখন বুঝিনি। সেসময় আমার মার্বেল কুঁচি দেওয়া দু ফুটের অ্যাকোয়ারিয়াম ছিল, তার মধ্যে গোটা দুই গোল্ডফিশ, অ্যাঞ্জেল এবং বেশ কিছু মলি থাকতো । ফলে ছাড়া পেয়েই শুরু হলো খোঁচানো , গোল্ডফিশ অসুস্থ, অ্যাঞ্জেল বিরক্ত, মলিগুলো আর নীচে নামছে না । তাই বাধ্যহয়েই হতভাগা তিনটের জায়গা করতে হলো উঠোনে মাটির গামলায় । সরু বালি দিলাম, কিছু ডালপালা আর পানা। এইভাবেই বছর তিনেক ছিল। নধরকান্তি তেলচুকচুকে চেহারা হয়েছিল, তবে গায়ের YOYO প্যাটার্নটা বড় হয়ে চেঞ্জ হয়ে অনেকটা হিজিবিজি দাগের মতো হয়ে গিয়েছিল। এতো মিশুকে ছিল যে খাবার সময় হলেই জলের সারফেসে এসে খুব হালকা একটা চটপট টাইপের আওয়াজও করতো , অনেক ধৈর্য ধরে খেয়াল করলে ব্যাপারটা বোঝা যেত। আমাকে বোধহয় কিছুটা চিনেও গিয়েছিল। সেবারে এক রাতে প্রবল বর্ষা হলো, সারারাত বৃষ্টিতে গামলা ভেসে মাছ তিনটে কোথায় যে চলে গেল। বড় দুঃখ পেয়েছিলাম । যাইহোক তারপর বহু বছর আর টাইগার লোচ পোষা হয়নি। আবার যখন পুষলাম তখন বছর দশেক পেড়িয়ে গেছে, ২০১৭-১৮ হবে।
ইচ্ছা হলো এদের একটা হ্যাবিট্যাট ট্যাঙ্ক করবো। কিন্তু হ্যাবিট্যাট তো আর এমনি এমনি হয় না, বিস্তর পড়াশোনা লাগে, ধৈর্য লাগে । শুরু হলো দীর্ঘ লিটারেচার রিভিউ, বইপত্র ঘাটাঘাটি । অনলাইনে বিস্তারিত তথ্য খোঁজাখুঁজি হলো, জানা গেল এদের নামেই ঘাপলা। আসল নাম আলমোরা লোচ, বৈজ্ঞানিক নাম Botia almorhae, বিদেশিরা বলে YOYO (ইয়োইয়ো) লোচ, আমাকে দোকানদার বলেছিল টাইগার লোচ আর বিদেশী লোকেরা ভাবে এ নাকি পাকিস্তানে পাওয়া যায়, তাই অনেকে বলে পাকিস্তানি লোচ । কিন্তু আদতে এরা ভারতেরই মাছ পাকিস্তানে এদের আরেক জাতভাই Botia birdi থাকে বটে কিন্তু এদের কোনভাবেই পাকিস্তানি ভাবার কারণ নেই, এরা একেবারেই শুদ্ধ দেশি । তবে মজার ব্যাপার হচ্ছে দেশি হলেও এরা যে ঘরকুনো তা কিন্তু নয়, এদের জন্ম হয় গারোয়াল হিমালয়ের খরস্রোতা নদীতে (কোশি, ঘর্ঘরা ইত্যাদি), যত বড় হয় এরা নীচের দিকে নামতে থাকে এবং তুলনামূলক কম স্রোতের জলের দিকে যেতে থাকে এবং প্রাপ্তবয়স্ক জীবনের বেশিরভাগটাই কাটায় মধ্য গঙ্গা সমভূমির জলাশয়গুলিতে । তবে যেখানে কাদা থাকে সেসব জায়গা এদের পছন্দ নয়। মূলত বালি থাকবে, জলে অক্সিজেনের পরিমাণ বেশি থাকবে এবং হালকা স্রোতে এরা ছোটো ছোটো দল বেঁধে ঘুরে বেড়াবে এই এদের চাহিদা। মোটামুটি একটা ৩৬×১২×১২” ট্যাঙ্ক হলে ভালোভাবে গোটা ছয়ের দল রাখা যায়। খাবার দাবার নিয়ে ঝামেলা নেই, যে কোন সিঙ্কিং ফুড ভালোই খায়, লাইভ, ফ্রোজেন এসব পেলে তো মহাখুশি। ড্রাই শুরুতে খেতে না চাইলেও অভ্যাস করালে তাও খায়। খোঁড়াখুঁড়ি এদের মূল কাজ তাই সাবস্ট্রেট হিসেবে খুব সুক্ষ বালি দেওয়া উচিত। যেহেতু এদের আঁশ থাকে না তাই খেয়াল রাখা উচিত কখনোই যেন ধারালো বালি বা ধারালো কোন পাথর ইত্যাদি এদের ট্যাঙ্কে ব্যবহার না করা হয়। সাথে আরো একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় এদের আঁশ নেই বলে কখনোই এদের ট্যাঙ্কের জলে লবন ব্যবহার করা উচিত নয়। এরা একদম স্বচ্ছ জলের মাছ , pH ৬.৬-৭.৫ এবং TDS ১০০-১৫০ এর মধ্যে থাকলেই ভালো। বর্তমানে হিমালয়ের নদীগুলোতে বাঁধ তৈরি, বনবাদার কেটে ফেলা, নদী দূষণ ইত্যাদির জন্য এদের বসবাসের পরিবেশের বিস্তর ক্ষতি হচ্ছে ।
ট্যাঙ্ক মেট হিসেবে এই মাছটিকে সবচেয়ে ভালো মানায় বিভিন্ন মাঝামাঝি আকৃতির বার্ব, বড় ড্যানিও এবং বড় রাসবোরাদের সাথে। যদিও অনেকেই এদের আফ্রিকান-আমেরিকান ইত্যাদি বহু ধরনের কমিউনিটি ট্যাঙ্কেই রাখেন তবুও বলবো খুব কম লোকই এদের হ্যাবিট্যাট ট্যাঙ্কে রাখেন। তাই একটু লম্বাটে অগভীর অ্যাকোয়ারিয়ামে একটু ফ্লো বেশি রাখলে এই সদা চনমনে মাছটি আপনাকে নিরাশ করবে না।
কাঠ, ডালপালার মধ্যে দিয়ে এদের লুকোচুরি, বালি খুঁড়ে খাবার খোঁজ, ভয় পেলে বালিতেই লুকিয়ে পড়া, কখনো কখনো মরার মতো পড়ে থাকা ইত্যাদি দেখতে দেখতে কখন যে আপনি এদের প্রেমে পড়ে যাবেন, ধরতে পারবেন না। বড় হলে ইঞ্চি পাঁচেক সাইজের এই মাছটির মহিলা ও পুরুষ কিন্তু সহজে চেনা যায় না। আর এরা যেহেতু মাইগ্রেটরি মাছ তাই সহজে অ্যাকোয়ারিয়ামেও ব্রিডিং করে না। বেশিরভাগ মাছ আজও প্রকৃতি থেকেই ধরা হয়। এই হার্ডি মাছটি বহুদিন ধরে বহু নতুন মেছোকে আনন্দ দিয়ে আসছে তবুও মাছটি সস্তা এবং সহজলভ্য বলে কোথাও যেন অনাদরেই বহু অ্যাকোয়ারিয়ামে শোভা পাচ্ছে। তাই হোক এদের জন্য স্পিসিস অনলি , হোক এদের জন্য হ্যাবিট্যাট ট্যাঙ্ক ….