Polypterus senegalus (Senegul Bichir)
বিচির মঙ্গল
সময়টা আঠারো শতকের শেষ, এশিয়ার বিভিন্ন অঞ্চল তখন ব্রিটিশ শাসনের অধীনে। দেশে দেশে কোম্পানির শাসন। দূর প্রাচ্য এবং প্রাশ্চাত্যের মাঝে তখন অটোমানদের রাজত্ব। ইউরোপীয় মূল ভূখণ্ডে তখন ইংরেজ আর ফরাসিদের রমরমা। নেপোলিয়ন ফরাসি কমান্ডার । সাম্রাজ্য বিস্তারের নেশায় তিনি ভাবলেন আক্রমণ করবেন মিশর, অটোমানদের হারিয়ে আরও পূর্বে অগ্রসর হবেন, এবং শেষ পর্যন্ত রাজ্য জয় করতে করতে ভারতে এসে পৌঁছবেন। তারপর টিপু সুলতানের সাথে যৌথ অভিযান চালিয়ে ভারতীয় উপমহাদেশ থেকে ইংরেজ খেদিয়ে দেবেন। যেমন ভাবা তেমনি কাজ, ১৭৯৮ সালে ফ্রান্সের পোর্ট টৌলন থেকে ১৩ টি যুদ্ধ জাহাজ, ১৪ টি ফ্রিগেট এবং ৪০০ ট্রান্সপোর্টারে চল্লিশ হাজার সৈন্য, দশ হাজার নাবিক,১৬৭ জন অ্যাকাডেমিশিয়ানকে নিয়ে বিশাল নৌবহর সুসজ্জিত করে নেপোলিয়ন ভূমধ্যসাগরে বেড়িয়ে পড়লেন। ভূমধ্যসাগর পেরিয়ে এসে তিনি আক্রমণ করলেন মিশরের আলেকজান্দ্রিয়া শহরকে, এবং বলা চলে বেশ সহজেই দখল করলেন। তারপর তিনি এগিয়ে চললেন কায়রোর দিকে। পথে মরুভূমি, সেখানে যুদ্ধ হল মামলুক উপজাতিদের সাথে, তাদেরকেও হারিয়ে দিলেন। অবশেষে কায়রো পৌঁছে কায়রো দখল করে নিলেন ।
এই পর্যন্ত পড়ে যদি যদি মনে হয় মাছের গ্রুপে ইতিহাস পড়ানো হচ্ছে, তবে প্লিজ আরেকটু ধৈর্য ধরুন । কারণ ইতিহাস নেপোলিয়নের মিশর অভিযানকে যত না মনে রেখেছে তারচেয়েও বেশি মনে রেখেছে পুরাতাত্ত্ব এবং জীববিজ্ঞান। কারণ নেপোলিয়ন এই অভিযানে শুধুমাত্র সৈন্যসামন্ত নিয়ে যাননি নিয়ে গিয়েছিলেন একঝাঁক ফ্রান্সের পন্ডিত ব্যক্তিদের যাঁদের মধ্যে ছিলেন সেসময়ের বিখ্যাত সব গানিতিক, পুরাতাত্ত্বিক, রসায়নবিদ, জীববিদ এমনকি সাহিত্যক এবং চিত্রকর্ম বিশারদগণও বাদ যাননি তাঁর তালিকা থেকে । এই সব গুণীজন মিশরে গিয়ে কি করলেন? জন্ম দিলেন ইজিপ্টোলজির, গড়ে তুললেন ইন্সিটিউট অব ইজিপ্ট, খুঁজে বের করলেন ভ্যালি অব কিংস, রোসেট্টা পাথর ইত্যাদি। এই দলেই একজন ছিলেন Geoffroy Saint-Hilaire, ২৬ বছর বয়সী ফরাসি জীব বিশারদ। তিনি নীল নদের অববাহিকায় খুঁজে বের করলেন এমন একটি মাছ যাঁদের বয়স প্রায় চারশো মিলিয়ন বছর । আর এই প্রাগৈতিহাসিক মাছটিকে নিয়েই আজকে আমাদের গল্প । সেই মাছটিকে এখন আমরা চিনি সেনেগাল বিসির নামে (Polypterus senegalus), বাঙালিরা যাঁদের ভালোবেসে নাম দিয়েছে “বিচির মাছ”।
নীলনদের মাঝামাঝি অববাহিকায় যেখানে সাউথ সুদান বলে একটা দেশ আছে সেখানে হোয়াইট নীল বলে নীলনদের একটা উপনদী আছে। সেই নদী মূল নীলনদে মেশার একটু আগে এক প্রকান্ড জলাভূমির সৃষ্টি করেছে। প্যাপাইরাসে ভরা সেই জলাভূমির নাম ‘সাড’ (Sudd) । জলহস্তী, নাইল ক্রোকোডাইল, গোলিয়াথ টাইগারফিশ, আফ্রিকান লাং ফিশ, হাইব্রিড মাগুরের মতো ভয়ঙ্কর সব রাক্ষুসে মাছের সাথে ওই সাডে বসবাস করে এই ছোট্ট মাছটি। আত্মরক্ষার্থে যাঁদের গায়ে বর্মের মতো মোটা মোটা আঁশ। আর চুপচাপ লুকিয়ে থাকে প্যাপাইরাসের শিকড়ের মধ্যে, তারপরেও প্রয়োজন পড়লে বা বিপদ বুঝলেই জল ছেড়ে উপরে উঠে দে দৌড়, একদম আমাদের কই মাছের মত ডাঙায় হাঁটতে পারে । বিসিরের ডাঙায় নিশ্বাস নেওয়ার ক্ষমতা, পাখনাকে সাঁতারের থেকেও বেশি পায়ের মতো ব্যবহারের প্রবণতা এদের দিয়েছে মাছ এবং উভচরের মধ্যেকার হারানো যোগসূত্র বা “মিসিং লিঙ্ক”-এর তকমা। ২০১৪ সালে কানাডার ম্যাকগিল ইউনিভার্সিটির কিছু স্কলার ট্যাঙ্ক-ব্রিড সেনেগাল বিসিরের ছানাদের জলের বাইরে ভিজে পরিবেশে এক বছর ধরে পালন করে এবং ডাঙায় হাঁটিয়ে রীতিমতো হাতেকলমে রিওয়াইন্ড করে দেখিয়েছেন বিবর্তনের গতিপ্রকৃতি। অতএব বুঝতেই পারছেন মাছটি বেশ কষ্ট সহিষ্ণু। আর সেটা হবেই না কেন এমনি কি আর লক্ষ লক্ষ বছর ধরে সেই ডাইনোসরদের যুগ থেকে বেঁচে আছে। তবে মনে রাখতে হবে এরা মূলত মাংসাশী। ছোটখাটো মাছ, শামুক, পোকামাকড় ইত্যাদি ধরে খায়। দিনের বেলা চোখে খুব একটা দেখতে পায় না, রাতের বেলা শিকারে বের হয়। এমনিতেই এদের গায়ের রং পাতাপচা কাদামাটির পরিবেশের সাথে একেবারে মিশে থাকে, আর রাতের বেলা তো কথাই নেই, প্রচন্ড রিফ্লেক্সে অসতর্ক শিকারকে মূহুর্তে মুখবন্দি করে।
অ্যাকোয়ারিয়ামে বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই এদের মন্সটার হিসাবে বা অন্যান্য বড় মন্সটার মাছের সাথে রাখা হয় বটে, তবে আমি যেহেতু ও পথের পথিক নই, তাই আমি আমার হ্যাবিট্যাট ট্যাঙ্কের লাইনেই হাঁটি। মোটামুটিভাবে একটা ৪৮×১৮×১৫” ট্যাঙ্ক হলে জমিয়ে বিসির হ্যাবিট্যাট নামিয়ে দেওয়া যায়। মিহি বালি , ডালপালা আর কিছু ভাসমান গাছ দিয়ে আলো আঁধারি পরিবেশ তৈরি করতে পারলে গোটা তিন-চার বিসির রেখে খেলা জমিয়ে দেওয়া যায় । সাথে কিছু পাতা, গুঁড়ি ইত্যাদি ব্যবহার করে লুকিয়ে থাকার জায়গা করে দিতে পারলে তো কথাই নেই। নিজেরা যেহেতু খুব একটা অন্য বিসির দের পাত্তা দেয় না তাই ঝগড়াঝাঁটি মারামারি নিয়েও চাপ নেই । বিসির দের অনেকগুলো প্রজাতি আফ্রিকাতেই পাওয়া যায়, তাদেরকেও অনেকেই একসাথে রাখেন, তবে যেহেতু সবাই সাইজে এক নয়, বড় ছোট নানান মাপের হয় তাই বিভিন্ন প্রকার বিসির রাখলে সাইজ বুঝেই রাখাই ভালো। আমি অবশ্যই বরাবরের মতো একটি প্রজাতি একসাথে রাখার পক্ষে। বরং সেনেগাল বিসিরের সাথে কিছু সায়নোডোন্টিস প্রজাতির ক্যাটফিস, মাঝারি আকৃতির তেলাপিয়া জাতীয় কোন মাছ রাখা যেতে পারে। তবে এদের মুখের চেয়ে ছোট কোন মাছ না রাখাই ভালো, নচেৎ কোন এক সকালে উঠে দেখবেন মাছ হাওয়া। আর বিসির নিজেই যাতে হাওয়া না হয় তার জন্যেও ট্যাঙ্কে ঢাকনা দেওয়া খুব জরুরি। কারণ ওরা টুক করে বাতাস নিতে উপরে উঠে চট করে লাভ দিতে পটু।
তবে এই মাছটিকে আপনি কমিউনিটি বা হ্যাবিট্যাট যে ট্যাঙ্কেই রাখুন জলের প্যারামিটার ঠিক রাখা কিন্তু জরুরি। মোটামুটি ৬.৫-৭ pH এবং ৩০০ এর নীচে TDS এদের জন্য আদর্শ। যেহেতু সাব ট্রপিক্যাল আফ্রিকার মাছ তাই শীতকালে একটা হিটার এদের জন্য দরকার । একটু ভালো ফিল্ট্রেশন, জলে হালকা ফ্লো; মোটামুটি একটু প্রোটিন বেসড সিঙ্কিং খাবার, একটু কেঁচো, মিল ওয়ার্ম, চিংড়ি এই তো এদের চাহিদা। তাহলে বস হবে নাকি এবার একটা সেনেগাল বিসির ট্যাঙ্ক?