Rosy Barb (Pethia conchonius)
পূর্বতন যশোর জেলার পশ্চিমের একটি অংশ একসময় বিল বাঁওড়ে ভর্তি ছিল। সেসময় বছরের বেশিরভাগ সময় বাঁওড়গুলিতে জল থাকতো, বিলগুলোর কিছু কিছু গরমে শুকিয়ে যেত। বর্ষায় বিলে মাছ পাওয়া যেত, শীতকালে তরকারি চাষ হতো। তখন মাথাভাঙ্গা, ইছামতি, চূর্ণী, যমুনা এসব নদীর প্রবল প্রতাপ ছিল। কোদালিয়া, বেতনা এসব নদী দিয়ে বড় বড় পালতোলা নৌকা বানিজ্য করতে যেত। নদী আর বাঁওড়ের মাঝে মাঝে বসতি থাকতো, ছোট ছোট গ্রাম বিশ-পঁচিশ ঘর বসতি নিয়ে তৈরি হতো। বিল বাঁওড়ের জমিতে চাষ-বাস করেই দিন চলতো। বর্ষার পরে হৈমন্তীক ধান চাষের চল ছিল। একটু ট্যাঁক জমিতে যো থাকলে কলাই, মুসুর এসব চাষ হতো। এসব এলাকার মানুষের মাছে-ভাতের অভাব কোনদিন ছিল না । বর্ষার জল নদী ছাপিয়ে ফি-বছর বন্যা হতো। নদীর মাছ বিল-বাঁওড়, ধানক্ষেতে আটকা পড়তো। আশ্বিন মাসে জল নামলে পাড়ার ছেলেপিলে কাদা মেখে জল ছেঁচে ওই মাছ ধরতো । বড়রা তাল গাছের গুঁড়ি দিয়ে ডোঙা বানিয়ে ঘুনি ফেলে মাছ ধরতো,ছোটরা তল্লা বাঁশ লম্বালম্বি চিঁড়ে মশারি আটকে ছুনি জাল বানিয়ে মাছ ধরতো। ছোটদের কাছে খলসে চাঁদা ছাড়াও আরও একটি মাছ জনপ্রিয় ছিল, কালচে লাল রঙের এক ধরনের পুঁটি। দেশি পুটি, তিতপুঁটির ঝাঁকে সেসব পুঁটি দু চারটে কখনো কখনো পড়তো, ওই পুঁটি মাটির চারিতে রেখে পোষা হতো । তারপর কালে কালে গঙ্গার জলপ্রবাহ অনেক পরিবর্তন হয়েছে। ভাগীরথী মজে গেছে, পদ্মা দিয়ে জল সব বেরিয়ে যাচ্ছে, উত্তর চব্বিশ পরগনার খালবিল সব মজে যাচ্ছে। যমুনা, বেতাই, কোদালিয়া সব মানুষের চাপে দখল হয়ে ভেরি-পুকুরে পরিনত হয়েছে। তবে প্রতিকূল পরিস্থিতির মধ্যেও উবে যায়নি সেই কালচে লাল রঙের কাঞ্চন পুঁটি বরং বহাল তবিয়তে টিকে আছে আমাদের মেছো হবিতে। তবে মেছো হবির মাছটা দেশির মতো কালচে লাল নয়, ঊজ্জ্বল সোনালী-কমলা, আদতে সিলেক্টিভ ব্রিডিং-এর ফলে তৈরি কালার মর্ফ। প্রকৃতিতে কিছু কাঞ্চন পুঁটির কমলাটে আভা থাকে বটে, সেগুলোকেই সিলেক্টিভ ব্রিডিং করিয়ে করিয়ে আজকের সুপার রেড “রোজি বার্ব” তৈরি হয়েছে। তবে রোজি বলুন আর কাঞ্চন ল্যাটিনে এদের একই নাম Pethia conchonius।
কাঞ্চন পুঁটি মুলত দলবদ্ধ মাছ, প্রকৃতিতে ৭০-৮০ টার বড় বড় ঝাঁকে ঘুরে ঘুরে শ্যাওলা খেয়ে বেড়ায়, এক একটি দলে অল্প কিছু পুরুষ এবং অনেক মহিলা থাকে। পুরুষদের গায়ের রং ঊজ্জ্বল কালচে সবুজ, মেয়েরা তুলনায় অনেক হালকা রঙের। তবে উভয়েই অন্যান্য পুঁটির তুলনায় একটু চওড়া। বর্ষাকালে দলবদ্ধভাবে স্রোতের বিপরীতে চলতে চলতে শ্যাওলার কার্পেটের উপর ডিম ছড়াতে ছড়াতে যায়, ডিম ফুটে বাচ্চা বের হলে জলের স্রোতে ভেসে যায়। ছোট বাচ্চারা অন্যান্য অনেক পুঁটির ঝাঁকের সাথে বড় হয়, বিশেষত বড় বড় তিত পুঁটি, তেঁড়ি পুটির বড় বড় ঝাঁকে এদের মিশে থাকতে দেখা যায়, তখন এদের আলাদা চেনাই দায়, ধীরে ধীরে বড় হলে এরা নিজেদের দল তৈরি করে । দলের সাধারণত একজন দলপতি থাকে, বাকি দল তাকে ফলো করে চলাফেরা করে।
প্রকৃতিতে এরা শ্যাওলা, পোকামাকড়ের লার্ভা, কেঁচো সবকিছুই খায়, সারাদিন জলজ গাছের জঙ্গলের ফাঁকে ফাঁকে খাবার খুঁজে বেড়ায়। অ্যাকোয়ারিয়ামেও খাবার নিয়ে বাছবিচার করে না, প্যালেট, ফ্লেক, ওয়ার্ম সবকিছু খায়, বরং খাবার জন্য খাই খাই করতে থাকে । কাঞ্চপুঁটি যেহেতু ঝাঁকের মাছ, তাই এদের রাখতে হলে ঝাঁকে রাখাই ভালো, নূন্যতম ১০-১২ টার গ্রুপে ৩-৪ টে মেল, ৬-৭ টা ফিমেল আদর্শ। জলের পি এইচ ৬.৫-৭.৫ , টিডিএস ৩০০ এর মধ্যে হলে যথেষ্ট। কিছু ডালপালা, ভাসমান পানা, ভ্যালিসনেরিয়া, চিংড়িদল, ঝাঁঝিমতো গাছপালা দিয়ে অ্যাকোয়ারিয়াম সাজানো যেতে পারে। একটা ৩×১.৫×১.৫ ফুটের ট্যাঙ্ক এদের একটা ঝাঁকের জন্য যথেষ্ট। সাথে খলসে, চাঁদা, অঞ্জু, বনকই জাতীয় মাছ রাখা যেতে পারে। তবে ঘন গাছপালা, ডার্ক সাবস্ট্রেট এদের রঙের জেল্লার উপর আলাদা মাত্রা এনে দেয়। হালকা থেকে মাঝারি ফ্লো কাঞ্চন পুঁটির পক্ষে আদর্শ। বর্তমানে বাজারে এদের ভেল টেইল সহ বিভিন্ন ভ্যারাইটি পাওয়া যাচ্ছে সেগুলোও যথেষ্ট আকর্ষণীয়।
শেষে একটা মজার কথা বলি এই পুঁটি কিন্তু টাইগার বার্বের সাথে ক্রস ব্রিডিং করে, টাইগার বার্বের মতোই লেজঝোলা মাছের লেজ টানাটানিতেও বেশ পটু, তাই স্লো, ভেইলটেল জাতীয় মাছের সাথে এদের রাখা নৈব নৈব চ।