Trichogaster chuna
গঙ্গানদীর উত্তরে ইন্দ্রদেবের বরে যে অঞ্চল সৃষ্টি হয়েছিল তাকে বলে বরেন্দ্রভূমি। পুরাণে বলা আছে দৈত্যরাজ বলির পত্নী সুদেষ্ণার; অঙ্গ, বঙ্গ, কলিঙ্গ , ওড্র এবং পুন্ড্র নামে পাঁচটি পুত্র ছিল। তারা প্রত্যেকেই মহাবীর। নিজেদের নামে এক একটি রাজ্য প্রতিষ্ঠা করেন । পান্ডুয়ার আশপাশের জায়গা পুন্ড্রের রাজত্ব ছিল। তার নাম থেকেই একে পৌন্ড্রদেশ এবং এর রাজধানীকে পৌন্ড্রপট্টন বলা হত। কালক্রমে বরেন্দ্র নামের একজন ক্ষত্রিয় পৌন্ড্র রাজ্য জয় করে এই রাজ্যের নাম বরেন্দ্রভূমি রাখেন। এই সেই ভূমি যাঁর সীমানা পশ্চিমে মহানদী থেকে পূর্বে করতোয়া পর্যন্ত এবং দক্ষিণে গঙ্গা থেকে উত্তরে তরাই পর্যন্ত বিস্তৃত। এখানে মাটির রং লাল, এবং প্রাচীন প্রিক্যাম্ব্রিয়ান যুগের পলি জমে এই অঞ্চলের সৃষ্টি । এখানেই হিমালয় থেকে বয়ে আসা নদীগুলোর স্রোত হারায়, গতি কমিয়ে বিনুনির মতো চলতে থাকে। মৃদুস্রোতা সেসব নদীতে অজস্র আগাছা, গুল্ম, শ্যাওলা জন্মায়। আর সেই শ্যাওলার দামে ঘুরে বেড়ায় ইঁটের মতো রঙের বিরল এক খলসে। যাঁকে বিজ্ঞান চেনে Trichogaster chuna নামে আর আমরা চিনি চুনা খলসে নামে। তাকে নিয়েই আজ আমাদের সাইজে চুনো হলে হবে কি মেজাজে কিন্তু ইনি আদপেই রাজা। নিজের পরিবেশে সারাদিন হুটোপুটি, হুল্লোড়, লুকোচুরি, মারামারি এই করেই সময় কাটে । আবার একটু ভয় পেয়েছে কি সোজা দৌড়, এক দৌড়ে ঝোপের মধ্যে, সেখান থেকে লুকিয়ে লুকিয়ে দেখা, বিপদ গেছে বুঝলেই টুক করে উপরে উঠে একটু বাতাস নিয়েই আবার হুটোপুটি শুরু। মোটামুটিভাবে মূল নদী এবং তার চারপাশের অঞ্চলের বিল বাঁওড় এদের সাকিন । বর্ষার জল নদীর পাড় ছাপিয়ে মাঠে-ঘাটে ঢুকলে সেখানেও এদের অবাধ যাতায়াত। ধান জমি, ঘেঁচুবন, ঘাসের মাঠই তখন ওদের ব্রিডিং গ্রাউন্ড। ঘাসের মাঠে কি শালুকবনে এক হাঁটু জলে একটু ভাসমান গাছপালা পেলেই হলো, ব্যাস ব্রিডিং শুরু । বর্ষার নতুন জলে পুরুষ মাছ সেখানে বুদ্বুদের বাসা বানায়। মহিলারা সেই বাসা পছন্দ করলে সেখানে ডিম পাড়ে, ডিম পাড়ার পর মায়ের দায়িত্ব শেষ। বাবাই তখন বাসা পাহারা দেয। বাচ্চারা ফ্রি সুইম করতে পারলে বাবারও ছুটি।ছোটবেলায় বাচ্চাদের গায়ে চোখ থেকে লেজ পর্যন্ত পার্শ্বরেখা বরাবর লম্বালম্বি একটা কালচে দাগ থাকে, বড় হতে হতে সেটা মিলিয়ে যায়। তখন পুরুষ মাছ গাড় বাদামি রঙের হয়, পিঠের পাখনার উপর হলুদ, আর মুখের কাছ থেকে পেটের নীচটায় কালো দাগ দেখা যায়। মেয়েদের রং অবশ্য খুব বেশি বাড়ে না, বড়জোর পার্শ্বরেখার বরাবর কালো দাগটা উঠে যায়।তবে অ্যাকোয়ারিয়াম এ মাছ সচরাচর দেখা পাওয়া যায় না, বরং খুঁজে পাওয়াই দুস্কর । দেশি মাছটির একটি কালার মর্ফ অবশ্য বিদেশে খুব সমাদৃত, সেই মাছটির রং আবার হলদেটে কমলা, সেজন্যই ওরা সেটাকে হানি গোরামি বলে ডাকে, সেটিকেই আবার বাংলা করে মধু খলসে নামে ডাকার চল এখানেও হয়েছে। তবে একথা নিঃসন্দেহে বলা যায় দেশি প্রজাতিটির স্থানীয় নাম কখনোই মধু খলসে বা মৌ খলসে ছিল না। যাইহোক কবি যেহেতু বলেছেন নামে কি বা এসে যায়, তাই আমরা নাম নিয়ে ভাবছি না। বরং একটা গাছপালা ভর্তি ট্যাঙ্কে গোটা কয়েক রাখলে কেমন লাগবে সেটা নিয়েই ভাবা যাক, যেহেতু মাছটি নিজেদের মধ্যে খুবই মারামারিবাজ তাই খুব ভালো ঘন বনজঙ্গল না করে একাধিক না রাখাই ভালো। একটা ফুট দুয়েকের অ্যাকোয়ারিয়াম হলে একটা মেল আর তিন-চারটে ফিমেল রাখাই যায়। যেহেতু খাবার দাবার নিয়ে বাছবিচার করে না কোঁচো থেকে ফ্লেক সবই চলে। তবে নিয়মিত লাইভ ফিডিং করালে রঙের জেল্লা বাড়ে। জলের পিএইচ যদি ৬.৫-৭ এর মধ্যে আর TDS ২০০ এর কাছাকাছি থাকে তবে তো কথাই নেই। মনের আনন্দে থাকে। যেহেতু মাছটি খুব ছোট (ইঞ্চি দেড়েক) তাই এদের সাথে খুব ছোট কিছু মাছ ছাড়া অন্য কিছু না রাখাই ভালো। ডোয়ার্ফ পুঁটি, ছোটখাটো রাসবোরা এরাই এদের আদর্শ পার্টনার। তবে কখনোই অন্যান্য ডোয়ার্ফ পুঁটি বা বেডিস গোত্রের মাছ না রাখাই ভালো। সবচেয়ে ভালো এদের জন্য একটা ডেডিকেটেড স্পিসিস অনলি ট্যাঙ্ক করা, এতেই এদের রং ও বিহেভিয়ার সবচেয়ে ভালো খোলে।আরও একটা কথা না বললেই নয়, সুন্দর এই দেশি মাছটা কিন্তু এখন নিজের বাসভূমিতেই বিপন্ন, শখের বশে দেশি মাছ পোষার চাহিদা যেমন এই মাছটিকে দূর্লভ করে তুলছে। তেমনি এদের ধরতে গিয়ে নির্বিচারে করা হচ্ছে এদের বাসভূমি ধ্বংস। তারউপর আছে নদী দূষণ, জলদূষন, বাসস্থান বিলুপ্তি, বিদেশি মাছের অনুপ্রবেশের মতো কঠিন কঠিন সব সমস্যা। সবমিলিয়ে প্রকৃতিতেই এদের প্রান ওষ্ঠাগত। আর এখানেই হয়তো হাতছানি দিচ্ছে একজন প্রকৃত মাছপুষিয়ের দায়িত্ববোধের জায়গাটা । যে কোন মাছ ভালো লাগলেই তাকে যে তাকে পুষতে হবে এমন তো নয়, বরং সে প্রকৃতির কোলে বেঁচেবর্তে থাকুক এটাই তো একজন মেছোর আসল চাওয়া । তাই আপনার কাছে আমাদের আবেদন দৃঢ়ভাবে না বলুন চুনা খলসের মতো বিরল দেশি মাছকে। সামান্য পয়সার লোভে কেনা ও বেচা দুইই বন্ধ হোক। থাকতে দিন ওদের নিজেদের পরিবেশে। বাড়তে দিন ওদের। আমাদের অ্যাকোয়ারিয়াম শোভা পাওয়ার চেয়ে ওটাই তো অনেক অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ। শেষপাতে বলে রাখি, একদা বল্লাল সেন এই বরেন্দ্রভূমিতেই দাঁড়িয়েই সমাজ সংস্কার করেছিলেন, শিক্ষা সংস্কার, ভূমিদান সংক্রান্ত অচলায়তন দূর করেছিলেন, সমাজে যোগ্যতার ভিত্তিতেই কুলিন প্রথা চালু ও নির্দিষ্ট সময় অন্তর তার পুনর্মূল্যায়নের ব্যবস্থা করেছিলেন। সেই বারেন্দ্রভূমি থেকেই খলসে প্রজাতির অন্যতম একটা কুলিন মাছ এভাবে হারিয়ে যাবে এটা কি আমরা মেনে নিতে পারি? পুষতে যদি হয় বিদেশে জনপ্রিয় ভ্যারাইটি হানি গোরামি পুষুন, দেশি চুনাদের দৃঢ়ভাবে না বলুন।