কাকজলার সেকাল – একাল
Pirates’ Den আয়োজিত এই সেগমেন্টে আমরা গল্প শুনি আমাদের আসেপাশের জলাভূমিগুলোর। জীববৈচিত্র্যের ভান্ডার এই জলাভূমিগুলোকে বাস্তুতন্ত্রের ফুসফুস বললেও অত্যুক্তি হয় না। কিন্তু খুব দ্রুতগতিতে এরা হারিয়ে যাচ্ছে, যার দায় আমাদেরও কম নয়। এই নিয়ে আলোচনা করা এবং সেই সূত্রে জনসচেতনতা ছড়ানো আমরা আশু কর্তব্য বলেই মনে করি।
গল্পটা শুরু করা যাক একটা ছোট পরিচয় দিয়ে। নদীয়া জেলার এক ছোট্ট গ্রাম, নাম ধরলাম কাকজলা। ছোট, সুন্দর আর পরিষ্কার একটা গ্রাম। সাধারণ খেটে খাওয়া মানুষের জীবিকা বলতে চাষ- আবাদ, পশু পালন আর মাছ শিকার। খুব স্বাভাবিক ভাবেই গ্রামের সিংহভাগ চাষ জমি, নদী ও খাল তীরবর্তী চারনভুমি। সারা গ্রাম জুড়ে ছড়িয়ে আছে ছোট ছোট বিল, জলা, পুকুর, বাওড়! এছাড়া বেশ কয়টি খাল আর তাদের প্রতিনিয়ত পুষ্টি জোগান দেওয়া হুগলি-ভাগীরথি নদীর অবিরাম প্রবাহ।প্রায় বছর ১৫ আগে থেকে জায়গা গুলোতে ঘুরে বেড়াই সুযোগ পেলেই। সেই ঘুরে বেড়ানোর সূত্রেই প্রথম পরিচয় হওয়া শুরু হয় দেশি মাছ, জলে গাছপালা, হরেক রকম পোকামাকড় , সরীসৃপ আর জলার পাখি। জলাভূমির প্রকারভেদে প্রাপ্ত প্রানীদের বিভিন্নতাকে তিন ভাগে ভাই করে নিচ্ছি লেখার সুবিধার্থে:-
পুকুর, বিল ও বাওড়- উক্ত এই তিন স্থলে এক সময় প্রচুর পরিমানে চোখে পড়ত হরেক রকম পুঁটি, শাল, শোল, গুতে, ট্যাংরা এর মত মাছ। পানকৌড়ি, ডাউক আর মাছরাঙার মত পাখি আসতো মাছ গুলোর লোভে। এছাড়া গেঁঢ়ী, গুগলি, ব্যাং, হরেক রকম সাপ ও গোসাপ দেখা যেত হামেশাই।বর্তমানে যে টুকু চোখে পড়ল তাতে দেখলাম দেশি বলতে যা বাকি আছে তা হল এ দেশীয় টাকা। জলা জবর দখল করে যথেচ্ছ ভাবে চলছে মাগুর, কাতলা, রুই, রুপচাঁদা, তেলাপিয়া মাছের চাষ। হাতে গুনে কিছু কাক আর শালিক ছাড়া কোনো পাখি চোখে পড়ে না। হয়তো মরশুম নয় তাই কোনো সাপ বা ব্যাং দেখলাম না।
খাল ও ধান ক্ষেত- বরাবরই সবচেয়ে কাছে এদেরই পেয়েছি , মাছের নেশার দায় অনেকটাই এদের ওপর বরতায়। দেঁড়ের ঝাক কিংবা তেচোখার জলের সাথে প্রথম পরিচয় এখানেই। খালের জলে খোলসে, তেচোখা, দেঁড়ে, বেলে, ল্যাঠা, শোল বর্ষার জলে এখনো দেখা যায়। একবার এক কাকা জাল ফেলে অনেক মাছের মধ্যে পেয়েছিল ট্যাপা, প্রথম দর্শন ও প্রাকৃতিক পরিবেশে শেষ দর্শন সেটাই ছিল। খালের পার্শবর্তী ধানের জমিতে কাঁকড়া, চিংড়ি, আপেল শামুক প্রচুর পেতাম, রাসায়নিক সারের প্রভাবে যা আজ শুধু শামুকে এসে ঠেকেছে। প্রশাসনের খাল সংস্কারের প্রতি উদাসীনতা খুব তাড়াতাড়ি সব শেষ করে দেবে।
নদী- গ্রামের প্রাণ, গ্রামবাসীদের অবসর কাটানোর প্রিয় জায়গা দুই নদীর মিলন স্থল। প্রচুর পরিমানে জলজ গাছ, যাদের নাম না জানায় আমি দোষী। ধেনো, তেচোখা, ফেলে, পুঁটি, বোয়াল, কুঁচে, কালবোশ, বাটা, চিংড়ি, কাঁকড়া আর কত কি। সময়ের সাথে এদের সংখা চোখে পড়ার মত হলেও বর্তমান সংখ্যাও নেহাত সামান্য নয়। তবে নদীর বালি চুরি কিংবা প্রতিদিনের কাপড় কাচার মত বিষয় গুলোর জন্য বাস্তুতন্ত্র বিপুল ক্ষতিগ্রস্থ। সব শেষে একটা বিশেষ তথ্য, এখানে বাস করে ‘One of the most majestic aquatic creature’ গাঙ্গেও ডলফিন বা শুশুক। সব প্রতিকূলতা কাটিয়ে আজও বিকেলের পড়ন্ত আলোয় দেখা দিয়ে যায় এই অনিন্দ্য সুন্দর প্রাণী।