ভিক্টোরিয়া ভালো নেই
লেক ভিক্টোরিয়া । আফ্রিকার গ্রেট রিফ্ট ভ্যালির সবচেয়ে বড় হ্রদ । পৃথিবীর দ্বিতীয় ও আফ্রিকার বৃহত্তম সুপেয় জলের হ্রদ । ২৬ হাজার স্কোয়ার মাইলের এই হ্রদের নাম শোনেনি এমন মৎসপ্রেমী সংখ্যায় বিরল । কারণ সিচলিড । ১৫-২০ হাজার বছরের বিবর্তনের ফল ৫০০-এর বেশি প্রজাতির রং-বেরংয়ের নেটিভ সিচলিড । বেশিরভাগই ওই হ্রদের Endemic species, যা পৃথিবীর অন্য কোন স্থানে পাওয়া যায় না । কিন্তু বিগত সত্তর বছরের মানুষের অপরিনামদর্শী ক্রিয়াকলাপে সেই সৌন্দর্য আজ অতীত । হারিয়ে গেছে ২০০-এর বেশি প্রজাতি (বেসরকারি মতে সংখ্যাটা আরো অনেক অনেক বেশি, ৮০-৯০%) টিমটিম করে কোনমতে টিকে আছে হাতে গোনা কয়েকটি প্রজাতি । বিশুদ্ধতা হারিয়েছে বহু । খাদ্যাভ্যাস, বাসস্থান বদলে তারা হারিয়েছে নিজস্ব বৈশিষ্ট্য । ভেঙ্গে পড়েছে সমগ্র হ্রদের বাস্তুতন্ত্র । এমন বহু ভিক্টোরিয়ান সিচলিড যা আজও অ্যাকোয়ারিয়ামে পোষা হয় তাদের আর কোন অস্তিত্বই নেই তাদের আদি বাসস্থানে । কিন্তু কেন এই ধ্বংসের জয়গান? সে ইতিহাস জানতে হলে আমাদের পিছিয়ে যেতে হবে প্রায় একশো বছর আগে । গত শতাব্দীর প্রথমার্ধে ।
সালটা ১৯২০, আফ্রিকার দেশ উগান্ডা তখন ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের দখলে। কলোনিয়াল প্রভুরা ভাবলেন এতো বড় মাপের হ্রদ পড়ে আছে মাছ চাষ করলে কেমন হয়? এতো বিশাল হ্রদে থাকে তো কিছু রং বেরঙের ছোট ছোট সিচলিড যাদের না আছে খাদ্যগুন না আছে মুনাফা; একেবারে বেকার মাছ বা “Trash fish”। তাই সেই Trash fish দের বড় মাছের খাদ্য বানিয়ে দেওয়া হোক আর ছাড়া হোক কিছু বড় মাছ যাদের অর্থনৈতিক মূল্যে প্রচুর । কিন্তু কি মাছ ছাড়া যায়? প্রস্তাব এলো তিলাপিয়া এবং নাইল পার্চ (Lates niloticus) ছাড়ার ।
কিন্তু বৈজ্ঞানিক-আধিকারিকদের একাংশের বিরোধিতার কারণে সে যাত্রায় নাইল পার্চ ছাড়া হলো না । ছাড়া হলো তিন ধরনের তিলাপিয়া মাছ । যথাক্রমে Red breasted tilapia (Coptodon rendalli), Red belly tilapia(C.zillli) ও নাইল তিলাপিয়া (Orechoromis niloticus) । ছাড়া পেয়েই এই তিনটি প্রজাতির মাছ হামলা শুরু করলো নেটিভ সিচলিডদের উপর । ভাগ বসালো খাবার ও বাসস্থানে । শুরু হলো নেটিভ মাছের বাচ্চা ধরে খাওয়া এবং নিজেদের দ্রুত বংশবৃদ্ধি ।
মুনাফার স্বাদ পাওয়া মানুষ এই ধ্বংসলীলা চোখের সামনে দেখেও যেন দেখলো না বরং শুরু হলো আরো মারাত্মক এক পরিকল্পনা । সালটা ১৯৫৪-৫৫, Uganda Game Fisheries Department(UGFD) ভিক্টোরিয়ার সংলগ্ন Kyoga হ্রদে ছেড়ে দিল ভয়ঙ্কর রাক্ষুসে মাছ নাইল পার্চ (যাদের দৈর্ঘ্য ছয় ফুট ও ওজন ২০০ কেজি পর্যন্ত হতে পারে)।
প্রথম দিকে এর প্রভাব সেভাবে চোখে না পড়লেও ধীরে ধীরে এর প্রভাব শুরু হলো । প্রথম পূর্ণবয়স্ক নাইল পার্চের দেখা পাওয়া গেল ১৯৭৯ সালে, কেনিয়ার Nyanza উপসাগরীয় অঞ্চলে । ২-৩ বছরের মধ্যে উগান্ডার জলভাগে এবং ৪-৫ বছরের মধ্যে তানজানিয়ার Mwanza উপসাগরীয় অঞ্চলে পূর্ণ বয়স্ক নাইল পার্চের অস্তিত্ব প্রমাণিত হলো, সালটা তখন ১৯৮৪-৮৫ । পরের বছরই অর্থাত্ ১৯৮৫-৮৬ নাগাদ ভিক্টোরিয়া হ্রদে প্রথম বার নাইল পার্চের বাচ্চা পাওয়া গেল । সেটাই হলো স্থানীয় জীবন বৈচিত্র ধ্বংসের চরম সময় । পরবর্তী দশ বছরে একটি প্রজাতির মাছ পুরো হ্রদের জীব বৈচিত্র্য ৪০% বিলুপ্ত করে দিল। নাইল পার্চ ছাড়ার আগে ভিক্টোরিয়া হ্রদে মোটামুটি ভাবে সাত ধরনের সিচলিড বসবাস করতো । যথাক্রমে, Herbivore (শাকাহারি, মুলতঃ জলজ শ্যাওলা ভোজী), Detrivore(ময়লা খাদক), Zooplanktonvore (প্রাণীকণা খাদক), Insectivore(পতঙ্গভূক), Molluscivores(শামুক-ঝিনুক খাদক), Picivore(মাছখোর), এবং Pawn-eaters(চিংড়িখোর) । কিন্তু নাইল পার্চের আগমনে Picivore, Pawn-eaters, Detrivore এবং Molluscivores রা সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হলো। একদিকে নাইল পার্চ যেমন তাদের খাদ্য ভাগ বসালো তেমনি তাদেরকেও ধরে ধরে খেতে লাগলো। এই চার ধরনের মাছ খাদ্য সংগ্রহের জন্য পাথুরে এলাকায় না থেকে খোলা জলে থাকতো ফলে এদের ধরে খাওয়া নাইল পার্চের পক্ষে অনেক বেশি সহজ হলো। তুলনামূলক ভাবে Insectivore, Herbivore, Zooplanktonvore রা পাথরের খাঁজে লুকিয়ে থেকে কিছুটা হলেও রক্ষা পেল। কিন্তু এতে শেষ রক্ষা হলো না। এই মাছগুলি একে অপরের উপর নির্ভরশীল হয়ে যে বাস্তুতন্ত্র রচনা করেছিল তা সম্পূর্ণ নষ্ট হয়ে গেল। উদাহরণ হিসেবে বলা যায় Detrivore রা সংখ্যায় অত্যন্ত কমে যাওয়ার জৈব পচনশীল পদার্থ হ্রদের জলের নীচেই পচতে থাকলো যা জলকে দ্রুত দুষিত করে তুললো এবং এর ফলেও বহু মাছ মরতে লাগলো । এভাবে একটা ধ্বংসের chain effect তৈরি হলো ।
যাইহোক, নাইল পার্চের আগমনে মানুষের একটা সুবিধা হলো, নাইল পার্চের অর্থনৈতিক মূল্য প্রচুর । তাই আফ্রিকার মতো গরীব মহাদেশের স্থানীয় বাজারে সেই মহার্ঘ সেই মাছ বিকোলো না। বিকোলো ইউরোপ-আমেরিকার বাজারে; উচ্চমূল্যে । ফলে চটজলদি হাল ফিরতে লাগল ভিক্টোরিয়ার জেলেদের। তাই দেখে মানুষ দ্রুত ভীড় করতে লাগলো ভিক্টোরিয়া হ্রদের চারিপাশে । হ্রদের চারপাশে গড়ে উঠতে লাগল একের পর এক মৎস বন্দর, জমে উঠল মৎস প্রক্রিয়াকরণ শিল্প ও বিদেশে চালানের ব্যবসা । কাটা হতে লাগলো জঙ্গল গড়ে উঠতে লাগল জনবসতি ও খামার । দেখতে দেখতে কয়েক বছরের মধ্যেই জনসংখ্যা পৌঁছে গেল ৩০ মিলিয়নের কাছাকাছি । এবং তা প্রতি বছর গড়ে ৩% হারে বাড়তে থাকলো । এর ফলে শুরু হলো overfishing । ফলে কমতে থাকলো নাইল পার্চের সংখ্যা । নব্বই এর দশকের শেষ দিকে একে বড় আকারের নাইল পার্চ বিরল হয়ে পড়লো । জেলেদের জালে পড়তে লাগলো মাঝারি ও ছোট আকারের নাইল পার্চ। আর্থিক তাড়নায় তাই ধরা চললো পুরোদমে । ফলে একটা সুবিধা হলো নাইল পার্চের পপুলেশন দ্রুত কমতে হতে লাগলো ।
এদিকে ততদিনে, নগরায়নের চাপে পিষে যেতে শুরু করেছে হ্রদের চারিপাশের স্বাভাবিক বাস্তুতন্ত্র । গাছপালা কেটে তৈরি হয়েছে বিশাল বিশাল খামার । ফলে লাফিয়ে লাফিয়ে বেড়েছে ভূমিক্ষয় । চাষের কাজে ব্যবহৃত সার-বিষ বৃষ্টির জলের সাথে মিশে ধুয়ে পড়তে লাগলো হ্রদের জলে। সাথে যোগ হলো নগরায়নের কুফল মানুষের তৈরি বর্জ্য, প্লাস্টিক, থার্মোকল ইত্যাদি ।
সবে মিলে যে সমস্যা গুলো দেখা দিল –
১] হ্রদের জল ঘোলা হয়ে সূর্যের আলো প্রবেশ রুদ্ধ করলো , ফলে নেটিভ গাছপালা মরে যেতে লাগলো ।
২] সিচলিডদের ব্রিডিং গ্রাউন্ড ক্ষতিগ্রস্থ হতে লাগলো , ফলে তাদের সংখ্যা আরো কমে যেতে থাকলো ।
৩] ফসফেট জাতীয় বর্জ্য Algae bloom করে দিল । যাঁর সম্মিলিত সুযোগ নিল আরো একটি invasive introduced weed, কচুরিপানা । দ্রুত ভরে যেতে থাকলো ভিক্টোরিয়া হ্রদের চারিপাশ । ২০০১ এ পৌঁছে এমন একটা অবস্থার সৃষ্টি হলো যখন ভিক্টোরিয়া হ্রদ যতদূর চোখ যায় যতদূর শুধুই কচুরিপানা । জল দেখা যায় না । এর কিছু সুফল ও কুফল দুই হলো –
প্রথমতঃ কচুরিপানার সৌজন্যে overfishing এ ভাঁটা পড়লো । ফলে কিছু কিছু প্রজাতি যাঁরা একেবারে বিলুপ্তির মুখে দাঁড়িয়ে ছিল তাঁরা কচুরিপানাকে আশ্রয় করে মানুষ ও নাইল পার্চের আক্রমণ দুটোই প্রতিরোধ করে টিকে থাকলো ।
দ্বিতীয়তঃ কচুরিপানা ব্যবহার করে হস্তশিল্প শুরু হলো । ফলে ঐ অঞ্চলে বিকল্প কর্মসংস্থান তৈরি হলো ।
তৃতীয়ত, হ্রদের চারিপাশের দেশগুলো এতোদিন পর নড়েচড়ে বসলো। শুরু হলো ভিক্টোরিয়া বাঁচাও অভিযান । মানুষজনকে সচেতন করার কাজ শুরু হলো। Waste management প্রকল্প গৃহীত হলো এবং হ্রদের স্বাভাবিক পরিবেশ ফিরিয়ে দেওয়ার জন্য দেশী-বিদেশি সরকারী-বেসরকারি সংস্থা এগিয়ে এলো। সম্মিলিত প্রচেষ্টায় ভিক্টোরিয়ায় বর্জ্যের আগমনে ভাঁটা পড়লো । ধীরে ধীরে কচুরিপানাও কমতে শুরু করলো । কিন্তু বহু বছরের অবহেলায় ভিক্টোরিয়ার মুখে যে বার্ধক্যের ক্লান্তির ছাপ পড়েছিল তা রয়েই গেল ।
দেখা গেল হ্রদের Zooplanktonvore ছাড়া বাকি প্রজাতির সিংহভাগ মাছই হয় বিলুপ্তির দরজায় কড়া নাড়ছে অথবা বিলুপ্ত হয়ে গেছে । তবে নব্বইয়ের দশকের শেষ দিকে নাইল পার্চ সংখ্যায় কমে যাওয়ার পর কিছু প্রজাতির মাছ পুনরায় স্বল্প সংখ্যায় পাওয়া যেতে শুরু হয়েছে । তাদের মধ্যে উল্খেযোগ্য হলো Haplochromis thereterion । দেখা গেল এই মাছটি আগে Open water এ বসবাস করতো কিন্তু বর্তমানে নাইল পার্চের ভয়ে গভীর জল ছেড়ে হ্রদের কিনারে পাথুরে অঞ্চলে ঘাঁটি গেড়েছে । খাদ্যাভ্যাস বদলে ফেলেছে । পতঙ্গভূক থেকে পতঙ্গের লার্ভাভূক হয়ে গেছে ।
তেমনি বিভিন্ন মাছের বাঁচার তাগিদে বিভিন্ন উপায় অবলম্বন করেছে-
১] কিছু মাছ পাপাইরাসের, (জলজ ঘাস) কচুরিপানার জঙ্গলে ঢুকে থেকে নিজেদের কোন রকমে রক্ষা করেছে ।
২] কেউ ঘোলা জলে থাকতে বাধ্য হয়েছে বলে অক্সিজেনের অভাবে তাদের ফুলকার আকার বড় হয়ে গেছে ।
৩] ঘোলা জলে ভালো দেখার প্রয়োজনে কারোর চোখের আকৃতি আগের তুলনায় বড় হয়েছে ।
৪] দ্রুত সাঁতার কেটে পালাবার জন্য কোন কোন মাছের লেজ ও বক্ষ পাখনা আকারে বড় হয়েছে । মাথার আকৃতি সরু ও ছোট হয়েছে। ইত্যাদি ।
পরিশেষে এখন প্রশ্ন ওঠে তাহলে যাঁরা হারিয়ে গেল তাঁরা কি একেবারেই গেল ? উত্তরটা কিছুটা হলেও আশাব্যঞ্জক । যেহেতু ভিক্টোরিয়ান সিচলিডরা রঙিন মাছের জগতে বেশ প্রসিদ্ধ ছিল, তাই কিছু প্রজাতির মাছ এখনো captive breeding এর মাধ্যমে টিকে আছে । যাঁদের আমারা বিভিন্ন অ্যাকোয়ারিয়ামে দেখা পাই। কিন্তু এদের Wild population ধ্বংস হয়ে গেছে মানুষের ইতিহাসের এক চরম স্বার্থপরতার কারণে । যতদিন পৃথিবীর যেখানে যেখানে নিজেদের স্বার্থে মানুষ এভাবে ছেড়ে চলবে introduce species দের ততদিন এরকম অনেক “ভিক্টোরিয়ারা” খারাপ থেকে আরো খারাপ থেকেই যাবে। ধন্যবাদ ।
তথ্যসূত্র: উইকিপিডিয়া, www.icungisd.org , www.nationalgeographic.org, www.columbia.edu