MIGRATORY FISHES – Fish Migration
“আমার নাইরে বাড়ি, নাইরে ঘর,
আমি এক যাযাবর।
কোথাকার বাসিন্দা আমি, কোথায় বাঁধলাম ঘর?
আমি এক যাযাবর….”
যাযাবর হওয়ার ইচ্ছে কার না হয়, কিন্তু ব্যস্ততার নাগরিক জীবন মানুষের সে অধিকার কোথায় ! কিন্তু এই পৃথিবীতে আছে এমন সব প্রাণী যাদের জীবনটাই এক কথায় “পায়ের তলার সর্ষে” । অজানার টানে তারা ছুটে চলে দিগন্তরেখার ওপারে । এরকম যাযাবর পাখি, স্তন্যপায়ীদের কথা আমরা প্রায়ই শুনি, কিন্তু ভাবতে অবাক লাগে এই দলে কিন্তু মাছেরাও পড়ে । আমরা জানবো সেরকমই কিছু মাছের সম্পর্কে যারা প্রকৃতির অমোঘ টানে ছুটে চলেছে পৃথিবীর একপ্রান্ত থেকে অন্যপ্রান্ত । তাই এবারে আমাদের লেখালিখির বিষয় ….
দেশান্তরী মাছেরা ( MIGRATORY FISHES)
===============================
জীবনধারণের প্রয়োজনে কোনো মাছ বা মাছেদের এক স্থান থেকে অন্যত্র চলে যাওয়াকেই মাছেদের পরিব্রাজন বা Fish Migration বলে । ইলিশ, স্যামন, সার্ডিন প্রভৃতি মাছেররা এভাবেই নদী বা সমুদ্রে হাজার হাজার মাইল অতিক্রম করে । কিন্তু কেন করে ? ঠিক কি কারণে এই মাছেরা ঝাঁকে ঝাঁকে বা একা একাই বহুদূরে পরিব্রাজন করে তা বিজ্ঞানীদের কাছে আজও এক গহীন রহস্য ।
তবু দীর্ঘ দিনের পর্যবক্ষেণ থেকে তাঁরা নিম্নলিখিত কারণ গুলিকে পরিব্রাজনের জন্য দায়ী করেছেন-
(১) খাদ্য সংগ্রহ :
সমুদ্রে বা নদীতে সারা বছর এক জায়গায় বসে খাবার পাওয়া যায় না । ফলে খাদ্যের প্রয়োজনেই মাছেরা দৈনিক বা ঋতুগত পরিব্রাজন করে । যেমন খাদ্যের প্রয়োজনে স্পার্ম হোয়েল বা হ্যামারহেড শার্কের দল এক মহাসাগর থেকে অন্য মহাসাগরে ঘুরে বেড়ায় । একে বিজ্ঞানীরা এলিমেন্টাল মাইগ্রেশন বলেন ।
(২) প্রজনন ও সঙ্গী নির্বাচন :
বহু মাছ সারাবছর যে পরিবেশে বসবাস করে, সেই পরিবেশটাই যে তাদের বাচ্চা জন্মানোর বা বাচ্চা বড়ো হওয়ার জন্য অনুকূল হবে এমনটা নাও হতে পারে । যদি না হয় তখন মাছেরা বাধ্য হয় প্রজননের জন্য উপযুক্ত পরিবেশ খুঁজতে এবং সেই উদ্দেশ্যেই পরিব্রাজন করে। স্যামন, ইলিশ প্রভৃতি মাছ এই কারনেই বহুদূর পরিব্রাজন করে ।
(৩) জলের উষ্ণতা ও ঋতু পরিবর্তন :
যেহেতু মাছেরা বেশিরভাগ শীতল রক্তের প্রাণী তাই বেঁচে থাকার জন্য উষ্ণ জলের প্রয়োজন হয় । শীতকালে শীত প্রধান দেশের নদী বা সমুদ্রের জলের তাপমাত্রা ভীষণ কমে যায়। এমনকি কোথাও কোথাও বরফও জমে যায় । তাই এই প্রতিকূল পরিবেশ থেকে রক্ষা পেতেই মাছেরা তুলনামূলক উষ্ণ জলের দিকে পরিব্রাজন শুরু করে । আবার ঋতু পরিবর্তন হলে পুনরায় তাদের পুরোনো বাসস্থানে ফিরে যায় । আবার কিছু কিছু মাছ অন্যান্য ঋতুতেও পরিব্রাজন করে যেমন আমাদের অতি পরিচিত কই মাছ বর্ষাকালে এক পুকুর থেকে বেড়িয়ে অন্য পুকুরে চলে যায় । আফ্রিকান ক্যাট ফিশের দল গ্রীষ্মকালে জলাশয় শুকিয়ে গেলে তুলনামূলক বড় জলাশয়ের খোঁজে কিছুদূর পর্যন্ত পারি দেয় ইত্যাদি ।
মাছেদের দেশান্তরী হওয়ার ধরন :-
সারা বিশ্ব জুড়ে গবেষণা চালিয়ে দেখা গেছে মাছেদের দেশান্তরী হওয়ার কতগুলো নির্দিষ্ট ধরন আছে। এর উপর নির্ভর করে মাছেদের মূলতঃ তিনটি দলে ভাগ করা যায়-
[অ] মিঠাজলচারী মাছ বা Potamodromus fish:
গ্রীক শব্দ Potamo যার অর্থ ‘নদী’ এবং Dromus যার অর্থ ‘বসবাসকারী’ শব্দ দুটি থেকে Potamodromus কথাটির উৎপত্তি । অর্থাত্ যে সকল মাছেরা মূলত নদীর মিঠেপানিতে বসবাস করে এবং সেখান থেকে বিভিন্ন প্রয়োজনে মিঠেপানিতেই পরিব্রাজন করে তাদের পোটামোড্রোমাস মাছ বলে । যেমন স্টারজেন, ফ্ল্যাটহেড ক্যাটফিশ প্রভৃতি মাছ এভাবে নদীতেই একপ্রান্ত থেকে অন্তপ্রান্তে ঘোরাঘুরি করে ।
[আ] সমুদ্রচারী মাছ বা Oceanodromus fish:
ইংরেজি শব্দ Ocean অর্থাত্ সমুদ্রে বসবাসকারী মাছেরা যখন তাদের জীবন ধারণের প্রয়োজনে সমুদ্রের নোনা জলের মধ্যেই ঘোরাঘুরি করে তখন তাদের সমুদ্রচারী বা Oceanodromus মাছ বলে । এই দলে প্রায় বারোশো প্রজাতির মাছেরা অবস্থান করে । সার্ডিন, হেরিং প্রভৃতি মাছেরা এই দলের গুরুত্বপূর্ণ সদস্য ।
[ই] উভজলচারী মাছ বা Diadromus fish:
যে সব মাছেরা তাদের জীবন চক্রের একটা অধ্যায় মিঠে জলে এবং অন্য একটি অধ্যায় নোনা জলে অতিবাহিত করে তাদের উভজলচারী মাছ বা didromus fish বলে। এই শ্রেণীটি আবার তিনটি উপ শ্রেনীতে বিভক্ত । যথা –
(i) Catadromus fish: যে সকল মাছেরা সমুদ্রে জন্মগ্রহণ করে এবং পূর্ণ বয়স্ক হওয়ার সাথে সাথে নদীতে ফিরে আসে তাদের ক্যাটাড্রোমাস মাছ বলে । দেখা যায় পূর্ণ বয়স্ক ক্যাটাড্রোমাস মাছেরা প্রজনন ঋতুতে সমুদ্রে পাড়ি দেয় । সমুদ্রেই প্রজনন করে ও বাচ্চার জন্ম দেয় । এরপর সেই সদ্য জন্মানো বাচ্চারা দীর্ঘ পথ পাড়ি দিয়ে নদীতে ফিরে আসে । এবং তাঁরাও যখন বড় হয় পুনরায় নতুন বাচ্চার জন্ম দিতে সমুদ্রে ফিরে যায় । এভাবে বংশানুক্রমে একটি চক্র চলতে থাকে। ঈল, অ্যাঙ্গলার মাছেরা এভাবেই পরিব্রাজন করে ।
(ii) Anadromus fish: স্বভাব চরিত্রে এরা ক্যাটাড্রোমাসের ঠিক উল্টো । অর্থাত্ সারা বছর এরা সমুদ্রের নোনা জলে বসবাস করে কিন্তু প্রজনন ঋতুতে এরা মিষ্টি জলে চলে আসে । দীর্ঘ পথের ক্লান্তিকর ও ঝুঁকিপূর্ণ যাত্রা অতিক্রম করে তাদের ব্রিডিং গ্রাউন্ডে পৌঁছায় এবং নতুন প্রজন্মের জন্ম দেয় । স্যামন ও ইলিশ মাছ এই দলের সদস্য ।
(iii) Amphidromus: সাধারণত নোনা জলের মাছ মিষ্টি জলে বাঁচে না এবং মিষ্টি জলের মাছ নোনা জলে বাঁচতে পারে না। কিন্তু পৃথিবীতে এমন কিছু বিশেষ প্রজাতির মাছ আছে যাঁরা অবলীলায় দুই ধরনের পরিবেশেই বাঁচতে পারে । এদের অ্যাম্ফিড্রোমাস মাছ বলে । খাদ্য অনুসন্ধান থেকে তাপমাত্রার পরিবর্তন যে কোন প্রয়োজনে এরা নদী, খাঁড়ি বা সমুদ্রে ঘোরাঘুরি করতে পারে । যেমন বুল শার্ক, ফ্রগফিশ, গারফিশ, গাউরি প্রভৃতি এর উদাহরণ ।
মাছেদের পরিব্রাজন ও বর্তমান সমস্যা :-
প্রাকৃতিক কারনেই মাছের পরিব্রাজন একটি কঠিন ঝুঁকিপূর্ণ বিষয় । তার উপর আধুনিক মানুষের অজ্ঞানতা ও অবিবেচনা পূর্ণ কাজ সেই প্রক্রিয়াটিকে আরো বহুগুণে সমস্যাপূর্ণ করে তুলেছে । নদীতে যথেচ্ছভাবে বাঁধ নির্মাণ মাছেদের গতিপথ রুদ্ধ করেছে, নির্বিচারে চলছে ছোট-বড় সব মাছ ধরা ফলে এই বিপন্ন প্রজাতিরা আরো বিপন্ন হয়ে চলেছে । এর সাথে আছে দূষণ, অতিরিক্ত water traffic, বাসভূমির ক্ষতি ইত্যাদির সমস্যা । ফলে বর্তমান সময়ে এই মাছগুলির জীবনে ত্রাহি ত্রাহি অবস্থা । পশ্চিমের দেশগুলিতে এই নিয়ে চর্চা ও সচেতনতা ধীরে ধীরে বৃদ্ধি হচ্ছে কিন্তু আমাদের মতো তৃতীয় বিশ্বের দেশে অবস্থা এখনো যে তিমিরে সেই তিমিরেই । কিন্তু এই অবস্থা দ্রুত কাটিয়ে উঠতে না পারলে আমাদের জলের বাস্তুতন্ত্র catastrophic disaster এর সম্মুখীন হবে। এই উদ্দেশ্যে ১৬ ই মে ২০২০ মৎস্য পরিব্রাজন দিবস হিসেবে বিশ্বজুড়ে পালিত হয়েছে । আসুন আমরা একত্রিত হয়ে এই মাছেদের রক্ষা করি , জল দূষণ তথা নদী/সমুদ্র দূষণ রোধ করি, ছোট ও অপ্রাপ্তবয়স্ক মাছ কেনা বন্ধ করি । ধন্যবাদ ।