Esomus danricus(Indian Flying Barb)

fishkeeping simplified

Esomus danricus(Indian Flying Barb)

দাড়কে/ ডানকোনা

দাড়িয়াল দাঁড়কেএক ছিল দেড়ে মাছ, দাড়ি তার মস্ত,

সেই দাড়ি নিয়ে শুধু ফাৎনায় ঘষতো।।

বৃহস্পতিবার শুভমুক্তি এই কড়ারে ট্রেলার বেরিয়ে গেছে, এদিকে আমি যথারীতি লিখে উঠতে পারিনি। তাই আজ ভোর থাকতে লিখতে বসেছি। আর পূর্বনির্ধারিত দাঁড়কে মাছ নিয়ে লিখতে বসেই মাথায় ঘুরপাক খাচ্ছে ওই ওপরের ছড়াখানা। কেন? সেই গল্প দিয়েই শুরু করি…..

অনেকদিন আগের কথা। ক্লাস টু কি থ্রিতে পড়ি। ছুটির দুপুরে বাবা ঠাকুরদার সাথে ছিপ ফেলে সময় কাটানো একরকম নেশায় পেয়ে বসেছিল। বাড়ির বিশাল পুকুর, বাবাদের হাতে বেশ দামি খান দুয়েক হুইল ছিপ, আমার হাতে তার শিশু সংস্করণ। কঞ্চির তৈরি হাতছিপ। মাছ আসলে ওরাই ধরতো, আমি ছিলাম ক্রিকেটের টুয়েলভথ ম্যান। এটা এগিয়ে দেওয়া, ওটা বাড়িয়ে দেওয়া এসবই ছিল আমার আসল কাজ। অবশ্য মাঝেমধ্যে আত্মহত্যা প্রবণ দুই একটা চ্যালা পুঁটি ট্যাংরা যে বঁড়শিতে গাঁথিনি তা নয়। তেমনই এক দুপুরে ছিপ ফেলে বসে আছি বাবাদের একটু তফাতে। ঠাকুরদা পইপই করে বলে দিয়েছে ফাৎনা পুরো ডুবলে তবেই টান দিতে। কিন্তু টোপ ফেলার পরমুহূর্ত থেকেই ফাৎনা যে আর চুপচাপ থকেনা! সদাসর্বদা তিরতির করে কেঁপে চলেছে, একটু ডুবছে আবার ভাসছে। আমিও থেকে থেকে টান মারছি অধৈর্য হয়ে, আবার নতুন করে টোপ গাঁথছি ফাঁকা বঁড়শিতে, আর তারপর সেই এক গল্প। ওদিকে ঠাকুরসা মুচকি হাসছে আমার দিকে তাকিয়ে, “দেড়ে মাছ লেগেছে তোর চারে, ওদিকে আর ফেলিসনে….” দেড়ে মাছ! সে আবার কি! রুই চিনি, কাতলা চিনি, কই পুঁটিও চিনি, এমনকি চ্যালা মাগুর শোলও চিনি। কিন্তু দেঁড়ে মাছ! কই না তো! সেই প্রথম শোনা দেঁড়ে মাছের নাম। স্বচক্ষে দেখেছি অবশ্য অনেক পরে। সেও এক গল্প! বলেই ফেলি সুযোগ যখন পেয়েছি!!!যাকে অতিবৃষ্টি বলে সেবার নাগাড়ে তাই হচ্ছে। বড় বড় দীঘির চক্রবুহ্যে ঘেরা আমাদের বাড়ীর রাস্তা উঠোন মাঠ সব হাঁটু জলের তলায়। বাবা কাকারা সব লম্বা লম্বা গামবুট পরে বাড়ী থেকে বেরোচ্ছে ঢুকছে। একদিন সুযোগ বুঝে তারই একজোড়া হাতিয়ে নিয়ে বেরিয়ে পড়েছি জল জমা মাঠে। সেবারই প্রথম দেখি বেশ বড় ঝাঁকে লম্বাটে গড়নের মাছগুলোকে জলের ওপর ভেসে থাকতে। একজোড়া গোঁফ বেশ স্পষ্ট আর ভালো করে লক্ষ্য করলে দেখা যায় দেহ বরাবর আড়াআড়ি কালো দাগ। তখন মাছ পোষার নেশাটা পাকাপোক্ত হয়েছে। একখন্ড চারফুটি অ্যাকোয়ারিয়াম আর গোটা কতক মাটির মেচলাও আছে। তো তাদের গোটাকতকে ধরে সেখানে রাখতে বিশেষ বেগ পেতে হল না। যদিও হঠাৎ একসাথে ডুব মেরে ফুট পাঁচেক দূরে আবার ঝাঁকসুদ্ধু ভেসে ওঠার বেয়াড়া বদভ্যাস আছে এদের। যাই হোক পরেরদিন আমাদের মালী জ্যেঠু এসে মাছ দেখে বললো এরা দেঁড়ে মাছ, অনেকে দাঁড়কে বলে। বেকার মাছ, কেউ খায়টায় না এদের। যদিও পরবর্তী কালে দক্ষিণবঙ্গের বিভিন্ন গ্রামে পাঁচমেশালি কুঁচো মাছের সাথে এদেরও মানুষের থালায় স্থান পেতে দেখেছি, কিন্তু সে ব্যতিক্রম। তো আজ সেই বেকার দাঁড়কে মাছ নিয়েই লিখতে বসেছি। যার লাতিন Esomus danricus। জটায়ু যেমন প্রখর রুদ্রর শারীরিক গঠন বর্ণনা করতেন খানিকটা সেই ভঙ্গীতেই বলে ফেলা যায় দেহ আয়তাকার, ওপর দিকে বাঁকানো মুখের সামনে একজোড়া গোঁফ, যার নীচের জোড়া বেশ বড়, ঝুলে প্রায় বুক পর্যন্ত চলে এসেছে (দাড়িও বলা চলে), অপর জোড়া অনেকটাই ছোট। গায়ের রঙ জলপাই এর সাথে সোনালী মেশানো। পাখনাগুলো মোটের ওপর স্বচ্ছ। বক্ষ-পাখনাজোড়া বাকিদের তুলনায় বেশ বড়। মুখ থেকে লেজের গোড়া পর্যন্ত অাড়াঅাড়ি স্পষ্ট কালো দাগ। দৈর্ঘে দু’আড়াই সেমির বেশি পাওয়া মুশকিল, যদিও এর অনেকটাই বড় আকারের দাঁড়কে পাওয়ার তথ্য আছে। স্ত্রী মাছ সাধারণ পুরুষগুলোর থেকে আকারে বড়, একটু হৃষ্টপুষ্টও।সমগ্র ভারতীয় উপমহাদেশের বিস্তীর্ণ এলাকায় এর বসবাস। আমাদের দক্ষিণবঙ্গের স্রোতহীন (বা ন্যূনতম স্রোতযুক্ত) জলাভূমিতে যথেচ্ছ পাওয়া যায়। হালকা জলের গাছপালাওয়ালা পুকুর দীঘি বিল বিশেষ পছন্দের। খাল নয়নজুলিতেও হামেশাই দেখা মেলে এদের। আর যেমন গোড়াতেই বলেছিলাম, বর্ষার জলে ডোবা মাঠ ঘাট এমনকি ধানক্ষেত এদের ভারি পছন্দের আবাসস্থল। তবে খুব একটা গভীর জলে যেতে পছন্দ করে না। কম থেকে মাঝারি গভীরতার জলায় থাকতে ভালবাসে। গভীর পুকুরের পাড় বরাবর দল বেঁধে ঘুরতে দেখা যায়। দলে থাকাই এদের স্বভাব। এক এক ঝাঁকে ডজন দু’এক (কখনও আরো বেশি) পর্যন্ত দাঁড়কে পাওয়া আশ্চর্যের নয়। জলের সারফেস বরাবর ভেসে বেড়ানো দাঁড়কেদের খুব পছন্দ। কোন কারণে ভয় পেলে ঝাঁক শুদ্ধু জলের নিচে ডুব মারে, খানিক পরে সামান্য তফাতে ভেসে ওঠে। জলের নিচেও কিন্তু দুর্বার গতিতে সাঁতর কাটতে পারে, আর বিপদ বুঝলে ঝাঁক বেঁধে জল থেকে লাফিয়ে ওঠে, সেই থেকেই বোধহয় এদের ইংরাজি নাম Indian Flying Barb। দেখতে কেমন, কোথায় পাওয়া যায়, স্বভাব চরিত্র সে সম্বন্ধে কিছুটা বলার চেষ্টা করলাম। এবার বলি অ্যাকোয়ারিয়ামে কিভাবে রাখা যাবে এদের। প্রথমেই বলে নিই এদের সুস্থ ভাবে রাখার জন্য মিনিমাম চারফুটের কম ট্যাঙ্ক ভাবাই উচিত নয়। রাখতে হবে বড় ঝাঁকে, তা না হলে আসল সৌন্দর্য উপভোগ করা যাবেনা। কিছু গাছপালা থাকলে বেশ হয়, পুরোডোবা আধডোবা গাছ সাথে কিছু ভাসমান পানা ঝাঁঝি, সেখানে একঝাঁক দাঁড়কে। সময় যে কিভাবে কেটে যাবে গাছপালা ঝাঁঝির ফাঁকে এদের লুকোচুরি দেখতে দেখতে, টের পাবেন না!!! সাথে যদি অন্য মাছ রাখতে চান তাহলে অ্যাগ্রেসিভ নয়, বা শিকারী নয় এমন মাছ রাখতে পারেন। কারণ তাড়া খেলেই এরা দল বেঁধে লাফ দিয়ে ট্যাঙ্কের বাইরে বেড়াতে যাবে। আমার পছন্দ নানা প্রজাতির খলসে, পুঁটি চাঁদাও রাখতে পারেন। সংখ্যায় কম রাখলে আর সঙ্গী হিসেবে বড় পাখনার মাছ থাকলে পাখনায় ঠুকরে ডাঁটাচচ্চড়ি করে দিতে পারে। সেই গোড়ায় বলা ছিপের ফাৎনার গল্প মনে আছে তো? জীবন্ত পোকামাকড় টিউবিফেক্স ব্লাডওয়ার্ম খুব পছন্দ করে। খাবার নিয়ে চাপ নেই। অভ্যাস করালে সহজেই ড্রাই ফুডসও খায় লাফিয়ে ঝাঁপিয়ে। তবে ফিল্ট্রেশনটা ভালো রাখতে হবে। ফ্লো হবে মডারেট। যদিও বেশ শক্তপোক্ত মাছ, তাও ইমম্যাচিওর ট্যাঙ্কে ছাড়া উচিত নয়।এবার সবশেষে একটা কথা বলি, যেটা দেশি মাছ নিয়ে লিখতে বসলেই বলে থাকি। এদের বর্তমান পরিস্থিতি। একসময়কার অত্যন্ত পরিচিত মাছ এখন গ্রাম বাংলা শহরতলি থেকে বেশ কমে গেছে। এর একটা বড় কারণ চাষের মাঠে ব্যবহৃত অতিরিক্ত কীটনাশক। এদের পছন্দের ব্রিডিং গ্রাউন্ড ধানক্ষেতে অন্যান্য আর পাঁচটা মাছের মতো এদেরও আর দেখতে পাওয়া দুস্কর। সাথে পুকুর, জলাভূমি চুরি তো নাগাড়ে চলছেই। জানিনা এর কোনো সমাধান আছে কি না। হবিতে এর জনপ্রিয়তা দিনদিন বাড়ছে। আপনাদের কাছে অনুরোধ যদি দেশি মাছ পুষতেই হয় তো পোষার মতো করে পুষুন। পছন্দের পরিবেশ দিন, উপযুক্ত স্পেস দিন। জলের দরে পাওয়া মাছ বলে অযত্নে রাখি এ দোষ যেন আমাদের মতো শখের মৎস্যপ্রেমীদের কেউ না দিতে পারে।শেষটা একটু অন্যভাবে করি। দুটো প্রশ্ন রাখি আমাদের বন্ধুদের কাছে। আমি এই মাছের যে আঞ্চলিক নামগুলো পেয়েছি সেগুলো হল – দেড়ে, দাঁড়কে, ডানকোনা, ঝিয়া, ডেরেচুনো। আপনাদের কাছে জিজ্ঞাসা, কারোর কি অন্য কোনো আঞ্চলিক নাম জানা আছে? আমি জানতে আগ্রহী। দ্বিতীয়, এদের ব্রিডিং বিহেভিয়ার নিয়ে আমার ধারণা ভীষণ কম। লিটারেচারেও বিশেষ পাইনি কিছু। কেউ এই ব্যপারে আলোকপাত করলে খুশি হব। তাহলে আজ এখানেই থাক। আবার কোনো এক বৃহস্পতিবার ফিরে আসবো অন্য কোনো মাছের গল্প নিয়ে। মেছো হবির নিত্যনৈমিত্তিক খবরের জন্য চোখ রাখুন আমাদের “Pirates’ Den” গ্রুপে.……

We are accepting the entries for IBAC

X