Neolamprologus brichardi(Brichardi cichlid )
বুরুন্ডির রাজকন্যে
আরো অনেক মাছের মতো বুরুন্ডির রাজকন্যের প্রথম দেখা পেয়েছিলাম জ্যোতির্ময়ের বাড়িতে। কি সুন্দর ছিপছিপে গড়নের একটা মাছ পাথরের ফাঁক থেকে বেরিয়ে আসছে, আর প্রায় তার দ্বিগুণ আকারের অন্যান্য মাছেদের তোয়াক্কা না করে ছোঁ-মেরে খাবার নিয়ে পালাচ্ছে। যেহেতু “প্রথম দেখায় প্রেম” কথাটায় আমার অটুট বিশ্বাস, তাই নিরুপায় হয়েই রাজকন্যের প্রেমে পড়তে হল। আচ্ছা এইবেলা বলে নিই রাজকন্যে কিন্তু নিতান্তই এক মাছ। অবশ্য আমাদের মতো শখের মেছুড়েরা প্রায়শই মাছের প্রেমে পড়ে, এতে চমকাবার কিছু নেই। তবে বাঙালী হয়ে যাকে রাজকন্যে বলছি তার ইংরেজি নাম Princeas of Burundi (লাতিন নাম Neolamprologus brichardi), অন্যান্য ইংরেজি নামগুলোর মধ্যে Fairy Cichlid, Lyre tail Cichlid, এমনকি শুধুই Brichardi Cichlid নামটাও ব্যবহৃত হয়।যদিও কেমন দেখতে সেটা বলার থেকে, সাথে দেওয়া ছবিতে একবার চোখ বুলিয়ে নিলেই হয়; শুধু এটুকু বলি, বেশ ছিপছিপে লম্বাটে গড়ন, দৈর্ঘ্যে বড়জোর ইঞ্চি তিনেক, গায়ের রঙ ছাইরঙা, কখনো আরো দু’এক পোঁচ কালচে। চোখের ঠিক পেছনেই পরস্পরের সাথে প্রায় সমকোণে লাগানো দুটো কালো দাগ, ঠিক যেন একটা “T” শোয়ানো আছে, যার গোড়াটা চোখ ছুঁয়ে আছে আর আগার আড়াটা কানকো বরাবির বিস্তৃত। পূর্ণবয়স্ক brichardi -র এই “T” এর কোলে উজ্জ্বল হলদেটে কমলা দাগ আসে। বাকি পাখনায় বাহুল্য না থাকলেও, বয়সের সাথে লেজ পাখনার ডগা বেশ লম্বাটে আকার নিয়ে একটু গুটিয়ে যায়, গ্রীক বাজনা Lyre এর সাথে ব্যপারটার সাযুজ্য থাকায় Lyre tail Cichlid নামটাও শোনা যায়।রাজকন্যের আবাসস্থল কোথায় জানতে হলে আফ্রিকার মানচিত্রের দিকে নজর দিতে হবে। পূর্ব আফ্রিকার বিখ্যাত হ্রদগুলোর মধ্যে অন্যতম ট্যাঙ্গানিকার দিকে নজর দিন, জলধারণ ক্ষমতায় দ্বিতীয় এই সুবিশাল লেকের পশ্চিম পাড় বরাবর প্রায় গোটাটাই রিপাবলিক অফ কঙ্গো আর পূর্ব পাড়ে তানজানিয়া, মাঝে মোটামুটি ৪৫-৫০ কিমি জলরাশি, এদিকে লেকের লেজটা ঝুলছে জাম্বিয়ায় আর মাথাটা শোয়ানো আছে প্রায় ৭০০ কিমি দূরে বুরুন্ডিতে। উত্তর প্রান্তের এই বুরুন্ডির তীরবর্তী অঞ্চলেই যে এদের বাড়বাড়ন্ত তা নিশ্চয়ই আর বলার অপেক্ষা রাখে না, তবেই না বুরুন্ডির রাজকন্যে বলে ডাকা হয়।তবে কটা শুষ্ক তথ্য এখানে না বললেই নয়। লিস্টি করতে বসলে Neolamprologus জেনাস কিন্তু এককথায় ট্যাঙ্গানিকার বৃহত্তম, অন্তত খান পঞ্চাশেক প্রজাতি আছে Neolamprologus-এর। যাদের অনেকের মধ্যে প্রায়শই হাইব্রিডাইজেশন ঘটে। আর তাছাড়া একই প্রজাতির মধ্যে ভ্যারিয়েশনও অনেক। ফলতঃ যত সময় গড়িয়েছে জটিলতা ততই বেড়েছে, এই যেমন ২০০৭ সালে প্রকাশিত এক গবেষণাপত্রে একদল বিজ্ঞানী প্রমাণ করলেন আমাদের রাজকন্যের (N. brichardi) সাথে নিকট আত্মীয় Daffodil Cichlid (Neolamprologus pulcher) এর জেনেটিক গঠনে পার্থক্য নেই, এরা আদপে একই প্রজাতি এবং যেহেতু N. pulcher এর লাতিন নামকরণ আগে হয়েছে তো N. brichardi নামটা রাখার প্রয়োজনীয়তাও নেই। সবইকে N. pulcher করে দাও। আবার অন্য একদল বলছে তাই যদি হবে তো N. brichardi কেনই বা শুধু উত্তর ট্যাঙ্গানিকায় পাওয়া যাবে? যেখানে N. pulcher এর সাম্রাজ্য অনেক বিস্তৃত!!! আর জটিলতায় ঢুকছিনা। সোজা বাংলায় বলি, Neolamprologus এর মধ্যে মোটামুটি দু’টো গোদা ভাগ আছে, একদল শেল ডুয়েলার্স বা ফাঁকা শামুকের খোলকেই ঘরবাড়ি বানিয়েছে (এদের গল্প পরে একসময় হবে’খন) আরেক দল পাথরবাসী বা রক্ ডুয়েলার্স। বুরুন্ডির রাজকন্যে পড়ে ওই দ্বিতীয় দলে। ট্যাঙ্গানিকার পাড়ের কাছাকাছি পাথরের ফাঁকে ফোকরে দল বেঁধে থাকে এরা। সুতরাং কেউ যদি এদের এদের নিজস্ব পরিবেশে রেখে ট্যাঙ্গানিকার জলে ডুব মারতে চান তো কাঁচবাক্সের সেটআপ খান সেরকমই হতে হবে।ট্যাঙ্ক সাইজ আমার মতে মিনিমাম তিন ফুট হলে সবথেকে ভালো। সাবস্ট্রেটে মিহি বালি, সাথে অনেক অনেক পাথর। পাথরগুলো একে অপরের ওপর এমনভাবে থাকবে যাতে মাঝখানে আড়াআড়ি ফাটল তৈরি হয়। শেল্টার হিসেবে এই জায়গাগুলোই brichardi দের বিশেষ পছন্দ। সাথে অবশ্যই খুব ভালো ফিল্ট্রেশন থাকা বাধ্যতামূলক, তবে খুব বেশি ফ্লো পছন্দ নয় এদের সেটাও মাথায় রাখা দরকার। আর একটা গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হল বেশিরভাগ আফ্রিকান সিকলিডদের মতো এরাও অত্যন্ত হার্ড ওয়াটারের মাছ, জলের pH প্রায় 9 এর কাছাকাছি থাকলে এরা স্বচ্ছন্দ বোধ করে। আর মেন্টেনেন্স বলতে সপ্তায় বড়জোর ১০-১৫% জল চেঞ্জ। ব্যাস আর কিছুর প্রয়োজনীয়তা নেই।খাবার ব্যাপারেও এরা সর্বভুক। লাইভ, ফ্লেক, পেলেট সবেতেই যথেষ্ট উৎসাহী। পাথরের ওপর বায়োফিল্ম অথবা অ্যালগি হলে তাও খুঁটে খুঁটে খেতে দেখেছি এদের। এক কথায় খাবার নিয়ে তেমন চিন্তা ভাবনা করতে হবে না।এবার আসা যাক ব্রিডিং বিহেভিয়ারে। ব্রিডিং করাতে হলে উপযুক্ত সেট আপে মিনিমাম ছটা কি বারোটা ছোট মাছ নিয়ে শুরু করা উচিত। যৌবন এলেই পাথরের ফাটলে, পাথরের গোড়ায় জোড়ায় জোড়ায় প্রেমালাপ করতে দেখতে পাবেন। মেয়েটিকে পছন্দসই পাথরের গোড়ার বালি খুঁড়তে দেখলেই ধরে নেওয়া যেতে পারে ডিম দেওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছে। পাথরের ফাঁকে উপযুক্ত ফাটল পেলে সেখানেও ডিম দিতে পারে। সব Neolamprologus এর মতো এরাও সাবস্ট্রেটে ডিম দেয়। ডিম দেওয়া হয়ে গেলে মেয়েটা খাওয়া ছাড়া অন্য প্রয়োজনে বিশেষ বেরোতে চায় না, ছেলেটা বরং বেশ রাগী রাগী মেজাজে আসপাশটা পাহারা দেয়। কারোরই তখন ধারেকাছে ঘেঁষার অনুমতি নেই। ব্রিডিং সাকসেসফুল হলে নির্দিষ্ট সময় পর মায়ের কাছাকাছি বাচ্চাদের ঘুরে বেড়াতে দেখা যায়। মা কিন্তু তখনও জায়গাটা বিশেষ ছাড়েনা, আসেপাশে কোথাও গেলেও কিছুক্ষণ অন্তরই এসে বাচ্চাদের দেখে যায়। বাবাও যথেষ্ট খেয়াল রাখে বাচ্চাদের। বাবা মায়ের এই জোড়া থেকে যায় মোটামুটি চিরদিনের জন্য। কিন্তু মজাটা হয় দ্বিতীয়বার ব্রিডিং এর সময় থেকে। ততদিনে প্রথমবারের বাচ্চারা একটু বড় হয়েছে, মানে অন্তত মাছ বলে চেনা যাচ্ছে। বয়সে কি আকারে ছোট হলেও ভাইবোনদের আদর যত্নের বহর দেখলে তা কিন্তু বোঝার উপায় নেই। ভাইবোনরা যাতে নির্দিষ্ট এলাকা ছেড়ে বেরিয়ে না যায় সে দিকে দাদাদিদিদের সজাগ নজর। বাবা মা রা তখন অনেক নিশ্চিন্তে পরেরবারের ব্রিডিং এর প্রস্তুতি নেয়। N. brichardi ট্যাঙ্কে একসাথে অনেক বয়সের বাচ্চা ঝাঁক বেঁধে ঘুরে বেড়াচ্ছে এ বেশ কমন দৃশ্য। সেই ঝাঁকে বিভিন্ন জোড়ার মাছও একসাথে থাকতে দেখা যায়। অ্যাডাল্ট মাছেরাও কখনো বাচ্চাদের ঘাঁটাতে আসেনা। সব মিলিয়ে সে এক মজার দৃশ্য।এরপর আর একটা দরকারি কথায় আসি, বুরুন্ডির রাজকুমারী সাথে অন্য কি মাছ রাখবেন। কিন্তু সত্যি বলছি এ বিষয়ে বলার জন্য আমি একদমই ঠিক লোক নয়। আমি বরাবরই স্পিসিস অনলি ট্যাঙ্ক করি। কারণ ব্রিডিং এর সময়ে বুরুন্ডির রাজকন্যেদের যা মেজাজ তাতে নিজের থেকে বড় আকারের মাছকে কোণঠাসা করে ফেলা এদের কাছে কোনো ব্যপারই না। অনেকে যদিও Julidochromis দের সাথে N. brichardi করার পরামর্শ দেন, কিন্তু আমি অন্তত খুব একটা আগ্রহী নয় এই ব্যপারে।তাহলে কি ভাবছেন? বাড়িতে রেখে দেখবেন নাকি Princess of Burundi? খুব সোজা কিন্তু। আর একবার রাখলে এদের ট্যাঙ্কের দিকে চেয়ে থাকা নেশায় পরিণত হবে সেটা আমি গ্যারেন্টিসহ বলতে পারি।