Parambassis sp.(Indian Glass Fish)
কাঁচের বাক্সে কাঁচের মাছ
কয়েকদিন থেকে ভাবছিলাম দেশি চাঁদা মাছদের নিয়ে কিছু লিখি, কিন্তু ল্যাদ খেয়ে লেখা আর হয়ে উঠছিল না। আজ সেসব ল্যাদকে দূরে সরিয়ে লিখে ফেললাম কটা কথা…..
আমাদের এই দক্ষিণবঙ্গের মোটামুটি সব অঞ্চলের স্থানীয় লোককে সেখানকার দেশি মাছের, মানে যাকে বলে wild মাছের নাম করতে বললে সবাই মোটামুটি এক নিশ্বাসে যে তিনটে মাছের নাম নেয় তাদের মধ্যে চাঁদা অন্যতম (বাকি দুটো যদি পুঁটি আর খলসে হয়)। সেই হিসেবে চাঁদা এখানকার বেশ সাধারণ মাছ। আর অন্তত দুই প্রজাতির চাঁদা প্রায় সর্বত্রই একসাথে পাওয়া যায়। গোলচাঁদা আর কাঠচাঁদা। যদি লাতিন নাম আপনার কাছে শ্রুতিমধুর লাগে (বাকিরা পড়বেন না মোটেও) তবে যথাক্রমে Parambassis ranga আর P. nama.নামেই পরিচয়, গোলচাঁদা আকারে অনেক গোলাকার সেখানে কাঠচাঁদা অনেকটাই লম্বাটে। পার্থক্যটা অনভ্যস্ত চোখেও চোখে পড়ার মতো। যদিও দু’জনের শরীরই দ্বিপার্শ্বিয় ভাবে চ্যাপ্টা আর স্বচ্ছও বটে। এই স্বচ্ছতায় অবশ্য গোলচাঁদা অনেক এগিয়ে কাঠচাঁদার থেকে আর সেই কারণেই তার চাহিদাও অনেক বেশি। আপনি বাইরে থেকে অনায়াসেই চাঁদার অন্তঃকঙ্কাল (মানে ঐ মাছের কাঁটা আর কি), অঙ্গপ্রত্যঙ্গ ভালো ভাবে দেখতে পারবেন। ইংরেজি নাম Glass Fish-টাও সেই কারণেই।এবার আসি কাঁচের মাছকে আপনার ঘরের কোণার কাঁচবাক্সে রাখতে গেলে কি করতে হবে। শুরুতেই বলে রাখি দেশি মাছ, যার আপাত খাদ্যমূল্য কম (যদিও চাঁদার টক খেলে, আঙুল আপনাকে চাটতেই হবে) তার সৌন্দর্যে মুগ্ধ হয়ে লোকে যদি তাদের বাসস্থান সংরক্ষণে উদ্যোগী হয় তবেই এই লেখার সার্থকতা। আর অতি সাধারণ দেশি মাছ হলেও, অ্যাকোয়ারিয়ামে সফলভাবে চাঁদামাছ রাখা খুব একটা সহজ নয়। “মূল্যহীন” মাছ তাই রেখেই দেখা যাক ভাবছেন যারা, তাদের জন্য এই মাছ নয়। সফলভাবে রাখতে হলে কয়েকটা বিষয়ে বিশেষভাবে নজর দিতে হবে। এক এক করে বলি…ট্যাঙ্ক সাইজ মিনিমাম দু’ফুট। আরো একটু বড় হলে ভালো হয়, কারণ এদের রাখতে হবে ঝাঁকে। মিনিমাম এক ডজন। তবেই মাছ স্ট্রেসড হবেনা আর সারভাইভাল রেট বেশির দিকে থাকবে। জলের TDS বা pH নিয়ে বিশেষ চাপ নেওয়ার দরকার নেই। নানারকম জল, মিষ্টি থেকে ক্ষারীয় (এমনকি ইষৎ নোনা জলেও) সব জায়গাতেই চাঁদার অবাধ বিচরণ। কিন্তু অবশ্য অবশ্যই ট্যাঙ্ক হতে হবে ব্যালেন্সড। ট্যাঙ্কের নাইট্রোজেন সাইকেল বেশ পরিণত না হলে কিন্তু সমূহ বিপদ। তাই নতুন ট্যাঙ্ক বানিয়েই ঝোঁকের বশে মাছ ছাড়তে হলে এই মাছ নৈব নৈব চ। সুতরাং ট্যাঙ্কের আয়তন বুঝে ফিল্ট্রেশনের জন্য প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিন। তবে খেয়াল রাখবেন জলের ফ্লো হবে মিনিমাম। এরা কিন্তু প্রায় স্রোতহীন জলাশয়ের মাছ, সেটা মাথায় রাখা দরকার। যদি সম্ভব হয় ট্যাঙ্কে গাছ দিন। ভ্যালিসনেরিয়া রোটালা, চিংড়িদল জাতীয় দেশি গাছ আর জলে ভাসমান নানা রকম পানা কি ঝাঁঝিতে কাজ মিটে যাবে। মাছগুলো সুরক্ষিত বোধ করবে আর আপনারও গাছের ফাঁকে মাছের খেলা দেখে মন ভালো হয়ে যাবে। পরিণত বয়েসের চাঁদাকে খুব সহজেই টিউবিফেক্স কি ব্লাডওয়ার্ম খাওয়ানো সম্ভব, কারণ প্রাকৃতিক পরিবেশে জলের পোকা, কেঁচো, ছোট্ট শামুক এসবই এদের পছন্দের খাবার। খুব ছোট সাইজের রাখলে, ডাফনিয়া (এবং অন্যান্য প্ল্যাঙ্কটন) ধরতে গামছা পরে পাড়ার পুকুরে নামতে হতে পারে। অবশ্য একবার কাঁচবাক্সের জীবনে মানিয়ে নিলে, ড্রাই ফুডস দিয়েও ভোজ সারতে দেখেছি চাঁদাদের।এবার বলি সাথে কাদের রাখবেন। দেশি বিদেশি একপাতে খাওয়ার ঘোরতর বিরোধী আমি। দেশির সাথে দেশিই রাখতে হবে। আপাত নিরীহ চাঁদাদের কিন্তু বদনাম আছে অন্য মাছেদের (প্রধানত পোনা জাতীয় মাছেদের) আঁশ খুঁটে দেওয়ার জন্য। সত্যতা যাচাই করিনি। কিন্তু আমার স্বল্প অভিজ্ঞতা থেকে বলতে পারি দেশি পুঁটির ঝাঁক কিংবা ঘোড়া দাঁড়িয়ার ঝাঁকের সাথে অনায়াসেই রাখা যায় চাঁদাদের। আমার ট্যাঙ্কে তো খলসেগুলোর সাথে রীতিমতো সখ্যতা ছিল এদের। সেগুলোর গল্পও নাহয় আস্তে আস্তে বলা যাবে।তবে হ্যাঁ আর দু’একটা নীতিকথা শুনিয়ে রাখি। প্রথমত, আপনার আমার বাড়ির আসেপাশের পুকুর, দিঘি, জলা, ডোবা, খাল, নয়নজুলিগুলো এদের আবাসভূমি। শুধু চাঁদার নয়, এদের মতো আরো অনেক সুন্দর সুন্দর দেশি মাছের। মানুষের লোভ দ্রুত গ্রাস করছে এই জলাভূমিগুলোকে। অতি দ্রুত হারিয়ে যাচ্ছে আসপাশের পুকুর ডোবা, আর তার সাথে সাথে আমাদের দেশি মাছের বিপুল সম্ভার৷ সচেতন হন, এলাকায় অবৈধভাবে পুকুর বোজানো হলে সোচ্চার হন। জলাভূমি গুলোকে প্লাস্টিক দূষণের হাত থেকে রক্ষা করুন। দ্বিতীয়ত, বাজারে বহুল পরিমাণে বিক্রিত ফ্লুরোসেন্ট কমলা বা সবজে কি নীল রঙের চাঁদামাছ দেখেই কিনে ফেলবেন না। এদের শরীরে এই রঙ ইনজেক্ট করা হয় অত্যন্ত বেদনাদায়ক উপায়ে। শুধু এই অমানবিক আচরণই যথেষ্ট এদের না কেনার কারণ হিসেবে। তাছাড়া এদের আয়ুও হয় মাত্র কিছুদিনের। কালার করা চাঁদা নিজে কিনবেন না, অন্য কোনো মেছোও যেন না কেনেন সেই সচেতনতা ছড়ান। তাহলে আর কি!!! ট্যাঙ্কটার নাইট্রোজেন সাইক্লিং শুরু করে দিন, কটা গাছপালা জোগাড় করে ফেলুন। একবার রেখেই দেখুন না, চাঁদা মাছ আপনার মন ভালো করে দেয় কি না!!! সাথে থাকলো আমার একটা দেশি ট্যাঙ্কের ছবি। যাতে একসময় ডজন খানেক চাঁদা মাছ ছিল। তারই একটার পাসপোর্ট ছবি তুলে দিয়েছিল এক ছাত্র। সেটার ছবিও থাকলো সাথে…..আচ্ছা হ্যাঁ, আর একটা কথা চুপিচুপি বলে রাখি ব্রিডিং সিজনে চাঁদারা নাকি বাসা বানায়, সেই বাসাতেই ডিম পাড়ে, পাহারা দেয়। গল্পই শুনেছি, দেখার সুযোগ হয়নি। বলা যায়না, হয়তো আপনার বাড়িতেই মিলতে পারে সেই সুযোগ। নিমন্ত্রণ করবেন কিন্তু…..