Some Native Monsters

fishkeeping simplified

Some Native Monsters

মিঠা জলের দেশি দৈত্যরা

====================

মন্সটার ফিস বা দৈত্যকার বলতে যাদের বোঝায় তাদের সবাই যে বিদেশী, সূদুর আমাজন, কঙ্গো বা নীল নদের বাসিন্দা এই ধারণা কিন্তু একেবারেই ঠিক নয়। আমাদের খাল-বিল-নদী-নালায় কিছু বাঙালি দৈত্য সেভাবে পাত্তা না ঘুরে বেড়াচ্ছে সে খবর আমরা ক’জনই বা রাখি। চলুন আজকে আমরা তাদের সুলুক সন্ধানেই বেড়িয়ে পড়ি…

(১) কাতলা (Catla/Labeo catla) :

দৈত্যাকৃতি দেশি মাছেদের দলে যদি কেউ নিরামিষাশী জেন্টল জায়ান্ট থাকে তবে নিঃসন্দেহে সেটি কাতলা। প্লাংটন, জলজ গাছপালা, অ্যালগি প্রভৃতিভোজী এই মাছটি আকারে হতে পারে প্রায় ছয় ফুট পর্যন্ত। ওজন সত্তর কেজির কাছাকাছি। দেহের গড়ন ভারী, মাথাটা মোটাসোটা, সারাদেহ কালচে আঁশে ঢাকা। সমগ্র দক্ষিণবঙ্গের মিঠাপানির নদীনালা এদের প্রাকৃতিক আবাসস্থল, সাধারণত অগভীর জলে জলজ দামের মধ্যে ঘুরে বেড়াতে ভালবাসে । তবে বর্ষাকালে প্রজননের সময় এরা নদী নালা ছাপিয়ে আসা জলের সাথে হামেশাই পুকুর খালবিলে ঢুকে পড়ে। পুকুর খালবিলে ঢুকলেও সেখানে স্থির জলে এরা কিন্তু ব্রিডিং করে না। এদের প্রজননের জন্য চাই স্রোতস্বিনী প্রবাহ। বর্তমানে নদী দূষণ ও বাসস্থান নষ্টের কারণে প্রাকৃতিক পরিবেশে দূর্লভ হয়ে পড়েছে। কিন্তু খাদ্য মাছ (Food fish) হিসেবে কদর থাকায় কৃত্রিম পদ্ধতিতে প্রজনন করা হচ্ছে বলেই ICUN তালিকায় Least Concern হিসেবে টিকে গেছে।

(২) শাল/গজাল (Channa marulius) :

লুকিয়ে থেকে আক্রমণকারী শিকারী মাছ হিসেবে এদের জুড়ি মেলা ভার। সাধারণত স্রোতহীন জলাশয়ের জলজ দামের মধ্যে লুকিয়ে থেকে তীব্র গতিতে শিকারের উপর ঝাঁপিয়ে পড়ে। মূলত ভোর ও সন্ধ্যা বেলায় একা একা শিকারে বের হয়, নিজের চেয়ে ছোট মাছ, চিংড়ি, কাঁকড়া, ব্যাঙ, সাপের বাচ্চা, হাঁসের বাচ্চা যা এদের সামনে এসে পড়ে নির্দ্ধিধায় আক্রমণ করে। পুরুষ মাছ একটা জলাশয়ের নির্দিষ্ট একটি এলাকা দখল করে রাখে। প্রজনন মৌসুমে স্ত্রী মাছের সাথে মিলে সম্মিলিত ভাবে এলাকাটি রক্ষা করে। সাধারণত বর্ষাকালে ৩০০-৫০০ টার মতো বাচ্চা দেয়। এই সময় মা-বাবা উভয়ে মিলে বাচ্চা চড়াতে থাকে। এই সময় এই মাছেরা এতোটাই aggressive হয়ে ওঠে যে মানুষকেও আক্রমণ করতে ছাড়ে না। শাল মাছ আক্রমণ করে মাংস তুলে নিয়ে গেছে এমন ঘটনা বিরল নয়। সাধারণত খুব বেশি হলে ৩-৪ ফুট সাইজের হতে দেখা যায়। তবে ৫ ফুট সাইজের ৩০ কেজি ওজনের শাল মাছের তথ্যও লিপিবদ্ধ আছে। মাছটির আকৃতির লম্বাটে। পৃষ্ঠ ও শ্রেনী পাখনা দেহের মাঝ বরাবর থেকে লেজ পর্যন্ত টানা থাকে। লেজটি গোলাকার। লেজের উপরে হলুদ ও কালো রঙের চোখের মতো একটা দাগ থাকে। কালচে সবুজ দেহের উপরেও ৫-৬ টি সাদা ও কালোর চাকা চাকা দাগ থাকে। চোখের মণির চারপাশে ঘন লাল বৃত্তের মতো অংশ মাছটিকে ভীষনদর্শন করে তুলেছে। ছোট অবস্থায় এরা দল বেঁধে বসবাস করে এবং দেহের সামনে থেকে লেজ পর্যন্ত পার্শ্বরেখা বরাবর উজ্জ্বল কমলা রঙের দাগ থাকে। বড় হওয়ার সাথে সাথে যা মিলিয়ে যায়।

(৩) সোনালী মহাশোল/Golden Mahaseer (Tor tor) :

সাইপ্রিনিডি পরিবারের এই দূর্লভ মাছটি পশ্চিমবঙ্গের উত্তর দিকের স্রোতস্বিনী পার্বত্য নদীগুলিতে সামান্য পরিমাণে পাওয়া যায়। তিস্তা ও রঙ্গিত নদী এদের প্রধান বাসা। সোনালী আঁশের মাছটি ওজনে প্রায় ৫০ কেজি ও আকারে প্রায় ৮-৯ ফিট হওয়ার তথ্য আছে। অত্যন্ত শক্তিশালী এই মাছটি দলবদ্ধ ভাবে ঘোরাফেরা করে। এবং সাধারণ বর্ষাকালে ৬-১০ হাজার ডিম পাড়ে। শীতল (৫-২৫°c), স্বচ্ছ ও উচ্চ অক্সিজেন যুক্ত জল মাছটির বিশেষ পছন্দ বলে পশ্চিমবঙ্গের দক্ষিণাংশে এদের দেখা যায় না। অত্যন্ত দ্রুত সাঁতারু মাছটি খাওয়া-দাওয়ার ব্যপারে সর্বভূক। তবে খাদ্য হিসেবে ও শখের মাছ শিকারীদের দ্বারা শিকারের ফলে মাছটির সংখ্যা দ্রুত কমে গেছে। এছাড়াও বাসস্থান নষ্ট হয়ে যাওয়া, নদী দূষণ প্রভৃতি কারণে মাছটি ICUN এর তালিকায় Endangered-এর তকমা পেয়ে গেছে।

(৪) চিতল (Chitala chitala) :

Knifefish পরিবারের সুস্বাদু এই মাছটির সাথে বাঙালির হেঁসেলের যোগাযোগ বহুদিন। ভারত ও বাংলাদেশের নদী নালায় এদের আবাস। পরিনত মাছ আকারে সাড়ে তিন ফুটের বেশি হতে পারে, ওজন প্রায় বিশ কেজির কাছাকাছি। বাঁকানো ধনুকের মতো পিঠের আকৃতি, সরু মুখ, শক্ত চোয়াল ও খুব ছোট ছোট রুপালি আঁশে ঢাকা শরীরের জন্য মাছটি দেখতে বেশ চিত্তাকর্ষক। পিঠের উপরের রং কালচে, সেখানে সারি সারি সমান্তরাল রুপালি দাগ থাকে। পিঠের পাখনা ছোট্ট, কিন্তু শ্রেণী পাখনা পেটের কাছ থেকে শুরু হয়ে লেজ পর্যন্ত জোড়া থাকে। স্বভাবে নিশাচর মাছটি সাধারণ রাতের বেলা একা একা শিকারে বেড় হয়। অন্যান্য শিকারী মাছকেও তখন দরকার পড়লে আক্রমণ করতে ছাড়ে না। মূলত প্রজনন মৌসুমে ডিম রক্ষার খুব আক্রমণাত্মক হয়ে ওঠে। শোনা যায় পুরুষ মাছ ডিমের উপর লেজ দিয়ে জল নাড়িয়ে অক্সিজেন সরবরাহ করে। খুব বড় নদী বা দীঘি ছাড়া আজকাল দেখতে পাওয়া কঠিন হয়ে যাচ্ছে, মূলত বাসস্থান কমে আসা এবং দেখলেই ধরে খাওয়ার জন্য প্রাকৃতিক পরিবেশে বিপন্ন হয়ে পড়েছে । তবে আশার কথা, বর্তমানে চাহিদা বৃদ্ধি পাওয়ায় কৃত্রিম প্রজনন করিয়ে চারা উৎপাদন করা হচ্ছে।

(৫) বোয়াল (Wallago attu) :

তৈলাক্ত, সুস্বাদু এই মাছটিও বাঙালির খাদ্য হিসেবে খুব প্রিয়। পূর্ণবয়স্ক মাছ ৫-৬ ফুট পর্যন্ত হতে পারে, ওজন হতে পারে ৫০ কেজির আশেপাশে। তবে আজকাল ৩ ফুটের চেয়ে বেশি বড় বোয়াল খুব দূর্লভ। মাছটির খুব ছোট ছোট রুপালি আঁশে ঢাকা। মুখের পাশে চারটি শুঁড় থাকে (দুটি বড়, দুটি ছোট)। দেহটি চ্যাপ্টা ও সরু। পিঠের পাখনা ছোট, শ্রেণী পাখনা বড়। বিশাল মুখের অধিকারী এই মাছটি নিশাচর, হিংস্র শিকারী, নিজের চেয়ে ছোট মাছ থেকে শুরু করে গেঁড়ি-গুগলি কাউকেই ছাড়ে না। চোয়াল ভর্তি অসংখ্য দাঁতের সারি দেখলে বোঝা যায় একবার শিকারকে ধরলে ছাড়ানো খুব মুশকিল। যে জলাশয়ে থাকে সেখানকার সব ছোট মাছ একাই খেয়ে সাবাড় করে দিতে পারে। সাধারণত মৃদু স্রোতস্বিনী নদী, খুব বড় দীঘি ইত্যাদিতে থাকতে পছন্দ করে। বর্তমানে সংখ্যা কমে গেছে, ICUN তালিকা জানাচ্ছে বিপন্নপ্রায় প্রজাতি।

(৬) বাঘাইর/Goonch catfish (Bagarius yarrelli) :

প্রকৃত অর্থেই জলের বাঘ। মহাশক্তিশালী ও হিংস্র এই মাছটির মানুষখেকো হিসেবে বদনাম আছে। যদিও এই বিষয়ে অনেকেই দ্বিমত পোষণ করেন, তবুও নিঃসন্দেহে এটুকু বলা যায় যে, পূর্ণবয়স্ক বাঘাইরের আক্রমণে বেকাদায় পড়লে মানুষের মৃত্যুর সম্ভবনা আছে। মূলত গঙ্গা,কালি, যমুনা(বাংলাদেশের) বড় নদীর স্রোতযুক্ত অংশ ও রিভারপুল গুলিতে এদের বসবাস। ছোট মাছ, ছোটখাটো প্রাণী এদের প্রধান খাদ্য। দেখতে শাঙ্কবাকৃতির, কালচে জলপাই রঙের শরীরের কালো কালো ছোপ থাকে। লেজের পাখনার উপর ও নীচের অংশে রে গুলি বড় বড়। মুখটি দেহের তুলনায় অস্বাভাবিক বড়, চোয়ালে তীক্ষ্ণ দাঁতের সারি। সাধারণত দলবদ্ধভাবে বসবাস করে। বর্ষার ঠিক আগে আগে ডিম পাড়ে। প্রায় দুই মিটার পর্যন্ত লম্বা হতে পারে বলে তথ্য আছে। সম্প্রতি (২০১৮) বাংলাদেশের কুশিয়ারা নদীতে একটি ১৮০ কেজি ওজনের গুঞ্চ ধরা পড়ে বলে সেখানকার স্থানীয় সংবাদপত্রে প্রকাশিত হয়। ICUN তালিকায় এই মাছটিও বিপন্ন প্রজাতি হিসেবে অন্তর্ভুক্ত হয়েছে।

•দৈত্যরাও ভ্যানিশ

দৈত্য বলেই তারা যে সুখে আছে এমনটা কিন্তু মোটেও নয়। মানুষের অপরিসীম লোভ লালসার স্বীকার হয়ে হারিয়ে যেতে বসেছে এরাও। নির্বিচারে ধরা, বাসস্থান নষ্ট করা, মানুষের নদী দখল, নদী দূষণ, বাঁধ নির্মাণ প্রভৃতি কারণে আজ এরা কেউ বিপদগ্রস্ত কেউ বিপন্ন বা কেউ কেউ মহাবিপন্ন হয়ে পড়েছে। শখের বশে এদের পুষতে গিয়ে হুমকির মুখে ঠেলে দেওয়া হচ্ছে এদের বন্য জনসংখ্যাকে। তাই এদের বাঁচাতে খুব দ্রুত সচেতন হতে হবে আমাদেরই । না হলে সেদিন দূরে নেই, যেদিন এই বাস্তবের দৈত্যরা শুধু গল্পকথার কাহিনী হয়ে রয়ে যাবে।

We are accepting the entries for IBAC

X