Trichopodus trichopterus (Three-spot Gourami/ Blue Gourami )
কয়েকদিন ধরে মনে করার চেষ্টা করছিলাম আমার সাথে কোন অ্যাকোয়ারিয়াম মাছের প্রথম আলাপ হয়েছিল! দেশি মাছ অনেকটা আগে থেকে রাখলেও নিজে প্রথম বিদেশি মাছ রেখেছি ক্লাস থ্রি-ফোরে পড়তে। তবে তার আগেই কয়েকটা মাছের সাথে আলাপ হয়ে গিয়েছিল মামার বাড়ির একটা চৌবাচ্চায়। তাদের মধ্যে একজোড়া সবজেটে নীল রঙের মাছ ছিল আমার ভীষণ প্রিয়। যদিও চৌবাচ্চা, কিন্তু ঝাঁঝির ফাঁকে তাদের নীলচে সবুজ রঙের ঝলকের স্মৃতি এখনো তাজা। আজকে এ নিয়ে এসেছি আমার ছোটবেলার স্মৃতির সেই নীল মাছের গল্প, যার পোষাকি নাম ব্লু-গোরামি বা থ্রি-স্পট গোরামি। আমাদের দেশে অ্যাকোয়ারিয়াম হবিতে এরা অত্যন্ত সুপরিচিত এবং সহজলভ্য মাছ। আকার আকৃতিতে আমাদের দেশি গোরামি বা খলসেদের সাথে যথেষ্ট মিল আছে। সেই একইরকম দু’পাশ চাপা স্লিম দেহ, সেই একই রকম সুতোর মতো একজোড়া শ্রোণি পাখনা। তবে লম্বাটে দেহ, অনেকটা পাটা খলসের (T. fasciatus) মতো। তবে গায়ের রঙ হালকা নীল, তার ওপর লম্বালম্বিভাবে গাঢ় রঙের আঁকিবুকি। লেজ পাখনা, পায়ু পাখনা আর পিঠ পাখনার শেষপ্রান্ত বরাবর হলদেটা রঙের ফোঁটা। লেজের গোড়া আর দেহের মধ্যভাগে একজোড়া কালচে টিপের মতো ছোপ, চোখটাকে ছোপ বলে গণ্য করলে আড়াআড়ি দেহের মাঝখান বরাবর একলাইনে তিনটে টিপ। যেখান থেকে থ্রি-স্পট গোরামি নামের উৎপত্তি। যদিও অ্যাকোয়ারিয়াম হবিতে ”কালার মর্ফ আর ভেরিয়েশনের ওপর নির্ভর করে আরো কটা নাম আছে, যেমন কসবি, গোল্ডেন, ওপালিন ইত্যাদি। নতুন হবিস্টের সবগুলো আলাদা আলাদা মাছ মনে হলেও, সবাই আসলে ব্লু-গোরামি বা Trichopodus trichopterus…এদের আবাসস্থলের খোঁজ নিতে হলে যেতে হবে মেকং নদীর অববাহিকায়। ম্যাপ দেখে বলতে হলে দক্ষিণ চীন হয়ে মায়ানমার, লাওস, থাইল্যান্ড, ভিয়েতনাম, কাম্বোডিয়ার বিস্তৃত অঞ্চল ব্লু-গোরামির আবাসভূমি। যদিও অনেক অ্যাকোয়ারিয়াম মাছের মতো এরাও শখের মাছ পুষিয়েদের নির্বুদ্ধিতা এবং হঠকারিতায় ছড়িয়ে পড়েছে আনকোরা দেশের বাস্তুতন্ত্রে। সে তালিকা করতে বসলে যোগ হবে তাইওয়ান, ফিলিপিন্স, পাপুয়ানিউগিনি, নামিবিয়া, কলম্বিয়ার মতো আরো অনেক দেশ। বাদ পড়বে না আমাদের দেশও।যাই হোক, দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার বিস্তীর্ণ অঞ্চলের কম গভীরতার জলাভূমিই এদের আঁতুড়ঘর। সেসব জায়গায় গাছপালার ঘন দামের মধ্যে ঘুরে বেড়ানোই এদের পছন্দ। বর্ষার জলে ডোবা জঙ্গল কি মাঠেও ঘুরে বেড়াতে দেখা যায়, ঠিক আমাদের দেশি খলসের মতো। আবার জল কমলে ফিরে আসে সারা বছর জল থাকে এমন নদী নালায়।ব্লু-গোরামি স্বভাব চরিত্রে কিন্তু বেশ রগচটা। যদিও আমরা বেশিরভাগই এদের কমিউনিটি অ্যাকোয়ারিয়ামে দেখে অভ্যস্ত কিন্তু এদের আসল রূপ দেখতে হলে, স্পিসিস অনলি ট্যাঙ্কে পছন্দের পরিবেশ দিতে হবে। অন্য পুরুষ গোরামিকে একচুল জায়গা ছাড়েনা প্রজনন ঋতুতে। আবার শুঁড়ের মতো শ্রোণিপাখনা নাড়িয়ে একজোড়া ব্লু-গোরামির প্রেম ভালোবাসাও একটা দেখার বিষয়।এরা দৈর্ঘ্যে বড়জোর সাড়ে পাঁচ ছয় ইঞ্চি হলেও এদের রাখতে হলে অন্তত তিনফুটের একটা ট্যাঙ্ক চাই। জলের উচ্চতা খুব একটা দরকারি নয়, সাত-আট ইঞ্চি যথেষ্ট, কিন্তু লম্বা জায়গাটা বেশ দরকারি। গাছপালা থাকবে ভালো পরিমাণে আর অনেকটা ভাসমান পানা, যার ফাঁক দিয়ে ঢোকা ঝুঁঝকো আলোয় এরা নিজের রূপ দেখাবে। জলে স্রোত এরা একদমই পছন্দ করেনা, স্পঞ্জ ফিল্টার এদের জন্য এক্কেবারে আদর্শ। বিভিন্ন রকমের জলের রকমফেরে ব্লু-গোরামি নিজেকে মানিয়ে নিতে পারে, কিন্তু একটু কম ক্ষারত্বের জলই এদের পছন্দের, এমনকি হালকা কালচে (ব্ল্যাকওয়াটার) জলেও এদের আপত্তি নেই। আর খাবার ব্যাপারে তো এরা উদারমনা, ড্রাই, লাইভ, ফ্রোজেন, ব্রিটানিয়া বিস্কুট, ডিমসেদ্ধ, পাঁউরুটি সবকিছুই চলে।প্রজনন অন্যান্য গোরামিদের মতোই বেশ সহজ। তবে খেয়াল রাখতে হবে একটা পুরুষ মাছ পিছু যেন দু’তিনটে স্ত্রী মাছ থাকে। কিভাবে চেনা যাবে স্ত্রী-পুরুষ! বেশিরভাগ গোরামিদের যেমন হয়, পৃষ্ঠ পাখনার ডগা পুরুষদের বেশি লম্বা। আর প্রজনন ঋতুতে ফিমেল একটু গোলগালও বটে। প্রাথমিক প্রেম ভালোবাসা পর্যায়ের পর পুরুষ মাছ ভাসমান পানার মধ্যে বুদবুদের বাসা বানায়, যা বাবল্ নেস্ট নামে পরিচিত। বাবল নেস্টের নিচে ডিম দেওয়ার পর স্ত্রী গোরামির দায়িত্ব শেষ হয়। ভাসমান ডিমগুলোকে পুরুষ মাছ সুন্দর করে সাজিয়ে রাখে বাবল নেস্টের মধ্যে এবং যত্ন আত্তি করে। তখন অন্য মাছ এমন কি মা গোরামিকেও আসেপাশে আসতে দেয়না। দিন দেড়েক বাদে ডিম ফোটা এবং আরো চার-পাঁচ দিন, যতক্ষণ না ছানারা নিজেরা সাঁতরাতে পারছে ততদিন বাবা গোরামির ছুটি নেই।কি ভাবছেন, করে দেখবেন নাকি ব্লু-গোরামি? অত্যন্ত সহজ, নতুন হবিস্টদের জন্য আদর্শ মাছ কিন্তু ভয়ানক ভাবে অবহেলিত অ্যাকোয়ারিয়াম মাছেদের মধ্যে অন্যতম এরা। খুব গুটিকতক মানুষজন আছেন যারা ব্লু-গোরামিকে পছন্দের পরিবেশ দেন। আপনিও একবার করে দেখতে পারেন। গাছপালার জঙ্গলের মধ্যে সবজেটে নীল রঙের ঝলক মনে থেকে যাবে বহুদিন।