দক্ষিণ বঙ্গের মরা নদীর গল্প
আমাদের বাংলার জলাভূমিগুলো ভূ-প্রকৃতির অন্যতম বৈশিষ্ট্যপূর্ণ অংশ। অঞ্চলভেদে, চারিত্রিক বৈচিত্র্যে কতরকম নাম তাদের নদী-নালা, খাল-বিল, জলা-বাঁওড়-দহ। এক-এক রকম জলাভূমির এক-এক রকম উৎপত্তির ইতিহাস, আর তার সাথে নানারকম জীববৈচিত্র্য। পাইরেটস’ ডেন চর্চা করে আমাদের আসেপাশে ছড়িয়ে থাকা নানা অজানা অচেনা জলাভূমির হাল হাকিকত নিয়ে। কেমন আছে জলাভূমিগুলো, কেমন আছে তার বাসিন্দারা, বাস্ততন্ত্রে এই সব ক্রমহ্রাসমান জলাভূমিগুলো কতটা গুরুত্বপূর্ণ সেই সব খবর পৌঁছে দেয় সমস্থ সদস্যের কাছে। এভাবেই যদি আমরা প্রকৃতির একটু কাছাকাছি পৌঁছতে পারি, প্রকৃতির গুরুত্ব একটু হলেও কিছুজনকে বোঝাতে বোঝাতে পারি তবেই এই ছোট্ট প্রয়াস সফল হবে। আসুন শুনি দক্ষিণবঙ্গের নদীর ধারে অযত্নে চোখের আড়ালে পড়ে থাকা বিল-বাঁওড়ের কথা…..
“দক্ষিণ বঙ্গের মরা নদীর গল্প”
যে নদী হারায়ে স্রোত চলিতে না পারে, সহস্র শৈবালদাম বাঁধে আসি তারে”আজ যেখানে আমাদের দক্ষিণ বঙ্গ, কুড়ি হাজার বছর আগেও সেখানেই ছিল বঙ্গোপসাগর, সেই হিমালয়ের মাথা থেকে নুড়ি বালি কাঁকড় বয়ে এনে এনে গঙ্গা নদী সাগর ভরিয়ে গড়ে তুললো গাঙ্গেয় বদ্বীপ সমভূমি। আর সেই সমভূমির দেহের মধ্যে দিয়ে শিরা-উপশিরারার মতো প্রবাহিত হতে লাগলো অসংখ্য ছোট ছোট নদী । কিন্তু কালের নিয়মে একদিন অপরিনত বদ্বীপ পরিনত হতে লাগলো, পলির ভারে বদ্বীপের ঢাল পশ্চিম থেকে পূর্ব দিকে ঢলতে শুরু করলো, ফলে পশ্চিমের ছোট নদীগুলিরও প্রয়োজনীয়তা ধীরে ধীরে ফুরোলো। প্রকৃতির নিয়মে পলি পড়ে মজে যেতে শুরু করলো একের পর এক নদীরা। কেউ কেউ কোন রকমে নিজেদের অস্তিত্ব আজও ধরে রাখতে পারলেও হারিয়ে গেল তাদের স্রোত, সর্বাঙ্গ ঢেকে গেল শ্যাওলায়। সেখানেই সৃষ্টি হলো নতুন ধরনের habitat, আজকে আমরা habitat সেগুলোই ঘুরে দেখবো। দেখবো তাঁদের ঋতুগত পরিবর্তন। তাহলে আর দেরি কেন চলুন শুরু করা যাক ….
• বর্ষাকাল : সারাবছর মৃতপ্রায় থাকার পর নদী এখন পুনরায় জীবন্ত হয়ে উঠতে শুরু করেছে। জল বাড়ছে। ছাপিয়ে যাচ্ছে নদীর দুপাশের ক্ষেত, খাল-বিল। মাটির নিচে লুকিয়ে থাকা শালুকের দল একসাথে পাতা ছাড়তে শুরু করেছে, অ্যাম্বুলিয়া, পানি কলায় ভর্তি হচ্ছে মাঠের পর মাঠ। দাঁড়াকে, খলসে, কাঞ্চন পুঁটির দল ঝাঁকে ঝাঁকে ঘুরছে। মাঠগুলো যেন এক একটা বিশাল প্লান্টেড অ্যাকোয়ারিয়াম। চিড়চিড়া, কেশরদামের দলে লুকিয়ে লুকিয়ে ঘুরছে জলপিপি, জলমুরগির দল, তাদের নতুন ছানারা উঁকিঝুঁকি দিচ্ছে পাতার ফাঁক থেকে। তবে দু এক সপ্তাহের মধ্যেই এই সৌন্দর্য চাপা পড়ে যাবে নাঙলের তলায়, বোনা হবে বোরো ধান। ধানক্ষেতে আলে যে ঢোলকলমির ঝোপটা আছে, ওখানে টিকে থাকা মাছগুলো ডিম পাড়বে ধানক্ষেতের আধহাঁটু জলে। সেসব হতে হতেই বর্ষা গড়িয়ে শীত এসে যাবে।
শীতকাল : ধানক্ষেতের জল এবার শুকোতে শুরু করেছে, কাঁকড়ার বাসার সামনে মাটি সব শুকিয়ে গেছে, সেখানে ভীড় করছে মেঠো ইঁদুরের দল। শীতের আগে ঝড়া ধান নিয়ে জড়ো করতে হবে সুরঙ্গের গভীরে। ধানক্ষেতের বাচ্চা মাছেরা নামতে শুরু করেছে মাঠের পাশে থাকা নয়ানজুলি গুলিতে। যেখানে ওদের জন্য অপেক্ষা করে আছে শাল, শোল, মাগুরের পোনারা। সফটশেল কচ্ছপরাও এখন খুব ব্যাস্ত, কলাগাছের গোড়ায় বাসাটা ঠিক আছে কিনা দেখে নিতে হবে, তারপর এক লম্বা শীতঘুম। একঘুমে গ্রীষ্মকাল।
•গ্রীষ্মকাল : নদীর এখন দৈন্য দশা প্রায় হেঁটেই পার হয়ে যাওয়া যায় এমন অবস্থা। ছোট ছোট মাছের দল প্রায় উধাও শুধু সকাল সন্ধ্যায় শোনা যায় শোল-শালের শিকার ধরার ছলাৎ ছলাৎ শব্দ। খাগড়াছড়ির বনটাও শুকিয়ে হলুদ হয়ে গেছে। নদীর পাড়ের সাদা বালি শুকনো বাতাসে হু হু করে উড়ছে। দূরে বাঁশবাগানে একটা খুরুলে মাছরাঙা এক নাগাড়ে ডাকছে, শিকারের আজ তার বড় অভাব। নয়ানজুলিরও আজ করুন অবস্থা। নতুন জল আসেনি প্রায় ছয়-সাত মাস, বাঁশ পাতা পড়ে পড়ে জল কালচে হয়ে গেছে, সেখানেই গাদাগাদি করে টিকে আছে কিছু কই, মাগুর, শিঙ্গি। অপেক্ষা পরের বর্ষার। বর্ষার নতুন জলে পাড় বেয়ে উঠবে কই, আবার ডিম পাড়বে বর্ষার খোলা মাঠে।এভাবেই চলে যায় এই নদীগুলি আর তার তীরবর্তী অঞ্চলে খাল-বিলেরগুলির জীবন, বছরের পর বছর যায়, নতুন নতুন সাজে সেজে ওঠে গাঙ্গেয় সমভূমির এই প্রান্তরগুলি। কোথাও কখনো শোলমাছে পোনা চড়িয়ে বেরায়, কোথাও মাঠের পর মাঠ ফুটে থাকে লাল-নীল-সাদা শালুকের দল, চড়ে শামুকখোল, ওড়ে পানকৌড়ি। তবে সব জীবনের গল্পই শুধু সুখের গল্প হয় না, দুঃখ আসে, কখনো কখনো ভীষণ ভাবে জাঁকিয়ে বসে। মানুষের হস্তক্ষেপ, দূষণ, নদী দখল, কীটনাশকের ব্যবহার এসব যেন সেই দুঃখের গল্প। শোনাবো সেসব গল্প, তবে আজ থাক, আজ না হয় সুখী জীবনের গল্প বলেই শেষ করলাম । ভালো থাকবেন। ধন্যবাদ।