Vallisneria spiralis
একটা সময় ছিল যখন গ্রামেগঞ্জে বাচ্চাদের জীবনে কোনকিছুরই বিশেষ তাড়া থাকতো না, দাদু-ঠাকুমা আদর করে ও দাদুভাই, দাদুভাই ওঠো বলে ঘুম ভাঙিয়ে দিত, চোখ বন্ধ অবস্থাতেই আদর করে কোলে বসাতো, দাদুভাইকে আধো ঘুম চোখে বলতো ” বড়ো করে আআআ করো তো দেখি” তারপর দাদুভাই ছোট্ট করে “আ” করবে, তক্ষুনি একটা আঁশশেওড়া কি নিমের ডাল মুখের ভিতর চালান করে দেওয়া হবে। আগা থেঁতলানো সেই নিমের ডাল দিয়ে দাদুভাই আয়েশ করে কোলে বসে মাজন করবে, তারপর চোখ খুলবে। চোখ খুলে একটু কিছু খেয়ে, নমঃ নমঃ করে পড়তে বসবে, বসা তো নয় অপেক্ষায় থাকা কখন নটার ঘন্টা বাজবে । মোটামুটি নটা বাজলেই বই-খাতা বাক্সে ভরে, শ্লেট পেন্সিল গুঁজে রেখেই সোজা ছুট, একছুটে নারকেল তেল মাথা জবজবে করে মেখে গামছাটা নিয়েই নদীর দিকে ছুট । এইসময়টা বন্ধুদেরও জানা, জুটে যায় একটা দল, তারপর নদীতে গিয়ে সোজা জলে ঝাঁপ। কখনো সে ঝাঁপ হয় সোজাসুজি, কখনো উল্টো, মানে সামারসল্ট, তবে ঝাঁপ যেমনই হোক না কেন টুক করে ডুব সাঁতার দিয়েই উঠে আসতে হয় পাড়ের দিকে, তারপর আবার ঝাঁপ। কখনো সাহসী ছেলেরা ঝাঁপিয়ে তুলে নিয়ে আনে নদীর তলার মাটি, সেই এঁটেল মাটি মাথায় মাখলে নাকি শ্যাম্পু হয়। চুল মোলায়েম হয়। গায়ে মাখলে গা পরিস্কার হয়। তবে গা পরিস্কার হোক না হোক ডুব দিয়ে মাটি তোলার সময় সাবধান থাকতে হয়, জলের নিচে পাতা শ্যাওলায় যেন পা না জড়িয়ে যায়, একবার জড়িয়ে গেলেই সেখান থেকে বেরোনো মুশকিল। নদীতে যেখানে বালি আর এঁটেল মাটি বেশি সেখানেই এই শ্যাওলা হয়, হাঁটু জল থেকে শুরু করে ডুবজল পর্যন্ত ঘন ঝোপ হয়ে থাকে। এত ঘন সে ঝোপ সেখানে বড় মাছেরাও সেই ঝোপে সহজে ঘেঁষতে পারে না, বাইরে দিয়ে উঁকিঝুঁকি মেরে চলে যায়, তাই ছোট ছোট বাচ্চা মাছের দল নির্ভয়ে ওই ঝোপে ঘুরে বেড়ায়। বর্ষার প্রথমে যখন নতুন জল ওঠে পুঁটি মাছের ঝাঁক এখানেই ডিম পাড়ে, বেলে মাছের বাচ্চা ওঁৎ পেতে থাকে সেই বাচ্চা খাবে বলে। তখন ছেলেপিলেরা একটা সিকনি জাল নিয়ে পাড়ের দিক থেকে পাতা শ্যাওলার ঝোপে আড়া মারে মাছ ধরবে বলে। খলসে, বন কই, চাঁদা, পুঁটি, মৌরলা কতোই না মাছ তখন সেখানে। ভোরের বেলা নদীর ধারে গেলে দেখা যায় পাতা শ্যাওলার ফুল হয়েছে, ছোট্ট ছোট্ট সাদা ফুল, স্প্রিং এর মতো ডাঁটিতে করে সেই ফুল জলের উপরে ভাসে। পাতি হাঁসের দল ওই ফুল খেতে আসা গেঁড়ি-গুগলি ধরে খায়, আর গ্রামের বাচ্চা মেয়েরা স্প্রিং এর মতো ডাঁটি নিয়ে মিছিমিছি কানের দুল, গলার হার এসব বানায়।
গ্রামেগঞ্জের এই শ্যাওলার আবার অ্যাকোয়ারিয়ামে খুব কদর সেখানে একে পাতা শ্যাওলা বলে কেউ ডাকে না, অক্সিজেন প্ল্যান্ট বলে, ভ্যালিসনেরিয়া (Vallisneria spiralis) বলে। এদের সেখানে কৃত্রিম আলোর নীচে পোঁতা হয়। মাটি, বালি যেখানেই পোঁতা হোক না কেন খুব তাড়াতাড়ি বাড়ে বলে অ্যাকোয়ারিয়ামের শখে এদের খুব কদর। মোটামুটি একটু জোরালো আলো আর একটু স্রোত এই তো এদের চাহিদা। তবে শুধুমাত্র গ্রাম বাংলার পাতাশ্যাওলা না, এদের দেশি বিদেশি বিভিন্ন জাতভাইদেরও অ্যাকোয়ারিয়ামের শখে বিশেষ কদর। তাদের আবার আলাদা আলাদা অনেক নাম, যাঁদের পাতা কোঁকড়া তাদের বলে কর্ক স্ক্রু ভ্যালিসনেরিয়া, আবার যাঁদের পাতা সরু সরু তাদের নাম নিডল লিফ ভ্যালিসনেরিয়া, আবার পাতাশ্যাওলার যে জাতভাইরা উত্তর আমেরিকায় থাকে তাদের নাম জঙ্গল ভ্যালিসনেরিয়া। এরকম বহু নাম থাকলেও এদের সবার মধ্যে একটা জিনিস কমন এরা সবারই চাহিদা বেশ কম । মানে একটু জোরালো আলো, একটু পুষ্টি পদার্থ যুক্ত সাবস্ট্রেট পেলেই হু হু করে রানার ছাড়তে থাকে, সেই রানার থেকে নতুন চারা হয়, এভাবে একটি মাত্র গাছ থেকেই কয়েক মাসেই বিশ-ত্রিশটা গাছ হয়ে যায়, তবে অ্যাকোয়ারিয়াম হোক বা প্রকৃতিতে জল যত বাড়তে থাকে গাছের পাতাও তত বড় হতে থাকে। দেশীয় ভ্যালিসনেরিয়ার পাতা তাই এক দেড় মানুষ সমান হয়ে যাওয়া কোন ব্যাপারই না। আবার যখন শীতকালে জল কমে যায় এই পাতা শ্যাওলারাই দুই ইঞ্চি জলেও কার্পেটের মতো হয়ে থাকতে পারে, তখন এদের পাতা হয়ে যায় বাদামি লাল। মোটামুটিভাবে একটু হালকা জল (pH ৬.৫-৭, TDS <২০০ থাকলেই এদের গ্রোথ হয় সবচেয়ে ভালো। আলো বেশি পেলে পাতা হয় চওড়া এবং কচি কলাপাতার মতো হালকা সবুজ, আলো যত কম হয় পাতা তত মোটা ও গাঢ় সবুজ হতে থাকে। খলসের মতো যেসব মাছেরা জলের উপর দিকে বাসা করে তাদের জন্য আদর্শ এদের পাতার জঙ্গল। এদের পাতাগুলো এতোটাই ঘন ক্যানোপি তৈরি করে সাধারণত সেই ক্যানোপি ভেদ করে খুব কম আলোই নীচ পর্যন্ত পৌছাতে পারে। তাই কোন জায়েন্ট প্রজাতির ভ্যালিসনেরিয়া অ্যাকোয়ারিয়ামে লাগালে মাঝে মাঝে পাতার উপরের অংশ কেটে দেওয়া হয় ।
তবে পাতা কাটুন না কাটুন সাঁতার কাটতে গিয়ে পায়ে না জড়ানোই ভালো, তবে এখন আর জড়াবেই বা কিভাবে, খালবিল তো আর সেভাবে নেই, যেগুলো টিকে আছে সেগুলোর জলে হয় প্লাস্টিক ভাসে, নয় কালচে, দুর্গন্ধ জল, সেখানে পাতা শ্যাওলাও হয় না ,আর পাতা শ্যাওলাদের জড়িয়ে ধরে এসব শৈশব-কৈশোরের গল্পেরাও জন্মায় না। সেই বেলে মাটির নদীর স্বচ্ছ জল, জলের নিচে পাতা শ্যাওলার বনে পুঁটি মাছের চকচক করে ওঠা এসব এখন যেন মনে হয় কত জনম আগের কথা। অজস্র বছর ধরে কবিদের মুগ্ধ করা বাংলার প্রকৃতি আজ যেন কচুরিপানায় ঢাকা বদ্ধ জলা। কাঁচের বাক্সের পার্লিং হতে থাকা অক্সিজেন প্ল্যান্টও ফিরিয়ে দিতে পারেনা সবুজ দিনগুলো ।