জলাভূমির জীবন গাথা
পশ্চিমবঙ্গ নদী, নালা, জলার দেশ। সেইসব জলে আমাদের কত অজানা, অদেখা সব বিস্ময় আছে তা আমাদের ধারণারও বাইরে । তবে যদিও সেইসব জলা এখন বিপদের সম্মুখীন নানা কারণে, চলুন আজকে এমন এক জলাভূমির গল্প শোনা যাক।
আজকের গল্পটি যাকে ঘিরে সেটি পূর্ব মেদিনীপুরের একটি নদী (নাম ধরুন অদিত্রি)। সুদূর ইংরেজ আমলে এই নদীর থেকে অনেক খাল কাটা হয় আর দুই পাড় বাঁধানো হয় চাষের জন্য। তবে এখন ইংরেজ রাও নেই আর বেশিরভাগ খাল এর অবস্থাও তথৈবচ, নদীটা কোনওরকমে টিকে আছে ।
বর্ষা ছাড়া বছরের বেশিরভাগ সময় নদীতে জল থাকেনা বললেই চলে, কয়েকটা বিচ্ছিন্ন জলা মত হয়ে যায়। এখানেই পাওয়া যায় নানা রকমের জলজ প্রাণী ও উদ্ভিদ ।
প্রথমে আসি আগে কি কি দেখা যেত। খলসে, নানারকম পুঁটি,চাঁদা,শাল,শোলা,ল্যাটা,ট্যাংরা, বেলে,তেঁচোখা,দেঁড়ে ,দেশি মাগুর,কই,badis,bumblebee goby,পাঁকাল,বান মাছ এসব ত হামেশাই দেখা যেত, সাথে কিছু বিরল মাছ যেমন Goonch বা leaf fish এরও দেখা মিলত। তবে এখন বেশি দেখা যায় পুঁটি,বেলে,জিওল মাছ,তেঁচোখা,goby,খলসে।Badis বা চাঁদা বর্ষাকালের সময় বেশি দেখা যায়। Goonch ত বিগত 4 বছর আমার চোখেই পড়েনি। Invertebrates মোটামুটি একরকমই আছে, ghost shrimp, apple snail,caridinia shrimp,trumpet snail,সুতি,চিতি কাঁকড়া, কাঁকড়া এগুলো খুব common এখানে। এছাড়া নানা রকমের জল মাকড়সার ও ফড়িং এর খোঁজ মেলে। আর মাছ আর পোকামাকড়ের সন্ধানে বক,পানকৌড়ি,মাছরাঙার নানা প্রজাতি ভিড় জমায়,শামুকখোল বা শরালের ঝাঁক ও ভালই দেখা যায়। গাছপালা মোটামুটি একরকমই আছে। নলখাগড়ার বন,eel grass এর জঙ্গল,hornwort এর ঝালর বা ঝাঁঝি গাছের পাতা ত বাচ্চা মাছের লোকানোর আদর্শ স্থান। সাথে কচুরিপানা বা পানি শিউলির মত floater দের ফুল জলাভূমির সৌন্দর্য বাড়ায়। মাঝে মাঝে কিছু জায়গায় শালুক ও ফুটতে দেখা যায় ।
তবে এইসব প্রাকৃতিক সম্পদ এখন বিপদের সম্মুখীন। মূল সমস্যা হচ্ছে চাষের জমিতে ব্যবহার করা নানারকমের রাসায়নিক সার ও কীটনাশক, যা শেষমেশ নদীতে এসেই মেশে। ফলে যা হয় BOD(biological oxygen demand) আর COD(chemical oxygen demand) বেড়ে গিয়ে Eutrophication হয়, গাছপালাতে নানারকম শ্যাওলা ভরে যায়, জল খারাপ হয়ে মাছ বা অন্য প্রাণীর বসবাসের অযোগ্য হয়ে যায়। তাছাড়া মাছ ধরার জন্য অনেক সময় স্থানীয়রা বিষের ব্যবহার করলে মাত্রাতিরিক্ত মাছ যে শুধু মারা যায় তা নয়,জল অনির্দিষ্টকালের জন্য মাছের সুস্থ বসবাসের অযোগ্য হয়ে যায় ।খালগুলি সংস্কারের অভাবে মজে যাওয়ায় বর্ষাকালে নদীতে প্রচুর জল এসে বন্যা পরিস্থিতি তৈরি হয়, তখন মাছ চাষের পুকুর থেকে আমেরিকান কার্প,গ্রাস কার্প,সিলভার কার্প,পাঙ্গস,তেলাপিয়া,nilotica মত বিদেশি মাছ ঢুকে পরে। এরা সাংঘাতিক রাক্ষুসে হওয়ায় গাছপালা খেয়ে নেয় আর বাচ্চা মাছের লুকানোর জায়গা হারিয়ে আমাদের নেটিভ মাছের সংখ্যা কমতে থাকে।আর সিকলিডদের এরকম তাপমাত্রা আর খাওয়ার জন্য চুনোপুঁটি থাকলে বংশবৃদ্ধি করে নেটিভ জলার যে কি করতে পারে তা সবারই জানা। তাছাড়া কিছু অবিবেচক হবিস্ট আছে যারা মাছের রিকোয়ারমেন্ট না জেনে কিনে নেয় কিন্তু পরে রাখতে না পেরে নদীতে ছেড়ে দেয়, তাই এখন জেলেদের জালে মাঝে মাঝেই pleco ওঠে। হয়ত এই নদীতে নয়,তবে মাত্র ৮ কিমি দুরে একটা ভেড়িতে দিনকয়েক আগে alligator gar পাওয়া যায়।বর্ষার সময় যদি এরকম মাছ একবার নদীতে ঢুকে যায় তাহলে কি হবে তা ভাবা যায়না।তবে যেহেতু নদী তাই পশ্চিমবঙ্গের অন্যান্য অনেক জলাভূমির মত এটিকে বুজিয়ে বাড়িঘর হয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা নেই। আর একটি বিপদ হচ্ছে বেআইনি ভাবে নদী থেকে যথেচ্ছ বালি তোলা হয়। তবে একটা সৌভাগ্য যে এখনো নেটিভ ফিস exploiter দের নজর বা হাত এদিকে পরেনি, তাই আপাতত এরা overharvesting এর থেকে বিপন্মুক্ত।
তবে আশার দিক ও কিছু আছে,সেচ দপ্তর এদিকের অনেকগুলো খাল ই সংস্কারে লেগেছে,তবে দীর্ঘসূত্রিতার জালে না পরে যত তাড়াতাড়ি এদের সংস্কার করা যায় তত মঙ্গল। কিন্তু আমাদের জলাভূমি ও তার অমূল্য রত্নগুলিকে বাঁচাতে আগে জনসচেতনতা গড়ে তুলতে হবে। আমরা কয়েকজন তা করার সচেষ্ট প্রচেষ্টা করছি,তাই এখন নদীতে কেউ বিষ দেয় না বললেই চলে। তাছাড়া নেটিভ মাছগুলোর ছবি ও live specimen দেখিয়ে লোকজনকে এদের সৌন্দর্য ও গুরুত্ব বোঝানোর চেষ্টা করছি। আশা করা যায় আমাদের এই দেশীয় সম্পদগুলিকে আমরা একটি সুন্দর ভবিষ্যত দিতে পারব…
বি.দ্র – আমি ইচ্ছে করেই জায়গাটার এক্সাক্ট লোকেশন উল্লেখ করিনি যাতে এই বাস্ততন্ত্র exploiter দের থেকে সুরক্ষিত থাকে। তাই দয়া করে লোকেশন জানতে চাইবেন না।আর কিছু ক্ষেত্রে মাছের habitat shot পাইনি বলে অ্যাকোরিয়ামের ছবি ব্যবহার করেছি