জলাভূমি ও আমরা
আপনি হয়তো এই গ্রুপে যোগ দিয়েছেন কারণ আপনি মালাউই সিকলিড সম্পর্কে জানতে চান, কিংবা মধ্য আমেরিকার লড়াকু মাছের প্রেমে পড়েছেন বা অল্প কিছুদিনে প্রেমে পড়তে চান। অথবা এরকমই কাছাকাছির কোনো ঘটনা। আফ্রিকার মাছ আমেরিকার মাছ দক্ষিণ পূর্ব এশিয়ার মাছ কেমন ভাবে ভালো রাখবেন জানতে চাইলেই অভিজ্ঞ হবিস্ট সাজেশন দেন তাদের প্রাকৃতিক পরিবেশ যেমন ঠিক তেমন ভাবেই তাদের রাখার। আপনি আমি সবাই সেই সাজেশন নিয়ে ভালো ফল পেয়েছি। রীতিমতো গুগল ঘাঁটাঘাঁটিও করে ফেলেছি কোনো মাছের প্রকৃতিক পরিবেশ কেমন তা জানার জন্য।কিন্তু আপনি কি ভেবে দেখেছেন আপনার নিজের এলাকার মাছের আবাসস্থল কেমন আছে? মৎস্যপ্রেমী হিসেবে সারা দেশে যাদের সুনাম সেই বাঙালির প্রিয় মাছেরা দ্রুত হারিয়ে যাচ্ছে কেন? একদা রোগীর পথ্য হিসেবে ব্যবহৃত সিঙ্গি মাগুর মাছের কেন আকাশছোঁয়া দাম। ন্যাদোশ, স্বর্ণপুঁটির মতো মাছ কেন হারিয়ে যাচ্ছে অতি দ্রুত? আর শুধু কি তাই কত শত জলের গাছপালায় সমৃদ্ধ আমার দেশ, আমার এলাকা। আমি আপনি খোঁজ রাখি না, অথচ কিছু আফ্রিকান গাছের শুধু লাতিন জেনাস, স্পিসিজ নামই নয় ছবি দেখে তার ভ্যারিয়েশন পর্যন্ত বলে দিচ্ছি।
এবার আমরা ভাববো, সাথে আপনাদেরও ভাবাবো!!!Pirates at Galiff নিয়ে আসছে নতুন এক সেকশন , যেখানে আপনাদের কাছেই আমরা জানতে চাই আপনার বাড়ির কাছের জলাভূমিটা কেমন আছে। কেমন মাছ পাওয়া যায়? আপনার ছেলেবেলায় দেখার স্মৃতির সাথে কোনো চোখে পড়ার মতো পার্থক্য পান কি? ছবি দেখতে চাই আপনার পরিচিত সেই সব জলাভূমির যা থেকে আপনি মেছো হবির ইন্সপিরেশন পান।
জলাভূমির বিপদ
———————————————-
আমার মাছ পোষার শুরুটা হয়েছিল তেচোখা মাছ দিয়ে। সৌভাগ্যক্রমে আমার বাড়ী কোলকাতা শহরের বাইরে, আর বাড়ীর পেছনেই নিজস্ব একখান পুকর আছে। সময় সুযোগ পেলেই পুকুরঘাটে ঘুরঘুর করতাম। লক্ষ্য থাকতো জলের ধার বরাবর ঘোরা মাছগুলোর দিকে। তেচোখা গুলোর সন্দেহ হলেই বর্মাশাক, কলমিশাকের দামে ঢুকে পড়তো। কিন্তু সময় দিলে ঠিকই বেরিয়ে আসতো, তখন মগ কি ছোট বালতি দিয়ে ধরে ফেলা খুব একটা অসুবিধের ছিলোনা। ঘাটে বাসন মাজার সময় তো আরো মজা, একখানা গামছা নিয়ে জলে নামলে তেচোখাদের সাথে সাথে দেশি পুঁটি, তিত পুঁটি, দাঁড়কেরাও জুটে যেত। জলে ঝাঁঝি, পানা টানা ভাসিয়ে মেজলায় রেখে দিতাম। দিব্যি থাকতো।এখনো বিদেশী মাছ পোষার সাথে সাথে সেই দেশী মাছেদের নিয়ে ভালবাসাটা থেকেই গেছে। পুকুরপাড়ে বসে হয়তো অতটা সময় আর কাটানো হয়না, কিন্তু নতুন কোথাও ঘোরার সুযোগ পেলেই সেখানকার জলাগুলো একবার দেখার বা কি মাছ পাওয়া যায় জানার চেষ্টা করি।একটু বলে নিই জলাভূমি কাদের বলবো। খুব বেশী থিওরির কচকচানি তে না গিয়ে বলতে পারি যেখানে জল জমে থাকে সেটাই জলা। হতে পারে সেটা বৃষ্টির জল কি বন্যার জল কিংবা খাঁড়ি অঞ্চলের জোয়ারের নোনা জল। হতে পারে সারাবছর জল থাকে অথবা মরশুমি। সেই হিসেবে আমাদের আশপাশের খাল বিল পুকুর ঝিল সবই নানা রকমের জলাভূমির উদাহরণ। আবার ধানক্ষেত নয়নজুলি কি ছোটো ডোবা যেখানে শুধু বছরের কয়েকটা মাস জল জমে থাকে, সেগুলোও জলা। আমাদের দেশী মাছেদের আবাস্থল এই জলাগুলো, এছাড়া এদের বিশেষ ভূমিকা আছে পরিবেশ এর ভারসাম্য রক্ষায়। এরা নীলকন্ঠের মতো আমাদের জলভান্ডার থেকে শুষে নেয় সব বিষ, সব দূষক পদার্থ। আমাদের শরীরের কিডনির প্রাকৃতিক রূপ যেন এই জলাভূমিগুলো। আর মরশুমি, হাঁটু জল থাকা জলাগুলোরও কিন্তু যথেষ্ট ভূমিকা আছে মাছেদের সংরক্ষণে। বর্ষায় ভেসে যাওয়া পুকুর খাল বিলের জল ধানক্ষেত নয়নজুলি নিচু মাঠগুলোতে ঢুকে পড়লে এরা হয়ে ওঠে বিভিন্ন দেশী মাছেদের আদর্শ ব্রিডিং গ্রাউন্ড। বিভিন্ন জায়গার মাছেদের এই মিশ্রণ তাদের জেনেটিক পরিকাঠামোকে আরো শক্তপোক্ত করে তোলে। বর্ষার জল জমা এই জলাগুলোতে যারাই পা ভিজিয়েছে তারাই জানে কত্ত রকম মাছ পাওয়া যায় এই নগণ্য জায়গাগুলোয়। জলে ভেসে থাকা পাতার নিচে কই মাছের বাচ্চা, সামান্য দু’আঙ্গুল জলে ল্যাটা মাছের নাড়াচাড়া, ঝাঁক বেঁধে মৌরলা কি পুঁটি মাছেদের ঘোরাফেরা থেকে নির্বিবাদী ধেনোমাছ কি ডানকোনা। এ এক আজব দুনিয়া!!! একবার দ্যাখা শুরু করলে প্রেমে পড়ে যেতে হয়!!!আমাদের এই দক্ষিণবঙ্গে জলাজমির অভাব কোনোদিনই ছিলনা, কিন্তু তাদের বেশিরভাগই এখন ভালো নেই। আমরা সভ্য মানুষজন দায়িত্ব নিয়ে এদের ধ্বংস করার খেলায় মেতে উঠেছি। কোথাও মাটি ফেলে বুজিয়ে ফ্ল্যাট শপিং মল খাড়া করছি তো কোথাও চাষে কীটনাশকের অতিরিক্ত ব্যবহারে এদের জীবন দুর্বিষহ করে তুলছি। বর্ষার জল ঢোকা মাঠে আগে যেখানে কার্ত্তিক মাস (নভেম্বর) পর্যন্ত নিয়মিত মাছ পাওয়া যেত সেখানে ভরা বর্ষায় মাছের আকাল। জমা জলে রাসায়নিকের প্রকোপ সহ্য করতে পারছে না ছোট মাছরা। ব্রিডিং এর জায়গা যাচ্ছে কমে। হাইওয়ে কি পিচ বাঁধানো উঁচু রাস্তার পাশ বরাবর ছুটে চলা নয়নজুলিগুলোও হয় বুজিয়ে ফেলা হচ্ছে, নয়তো প্লাস্টিক এবং অন্য আবর্জনা ফেলে মাছেদের আবাসের জন্য অনুপযুক্ত করে তোলা হচ্ছে। আধডুবি নানা জলার গাছে ভরা মাছেদের এই চারণভূমিও ধীরে ধীরে হারিয়ে যাচ্ছে।এছাড়া রয়েছে পুকুর, ঝিলের পাড় বাঁধিয়ে তাদের সভ্য বানানোর বিপদ। শুধু মাছ তো না!!! প্রকৃতির ভারসাম্য রক্ষায় জরুরী খাদ্যশৃঙ্খলের অন্যান্য সদস্য ব্যাঙ, সাপ, গোসাপদেরও আমরা আস্তে আস্তে নিয়ে ঠেলে দিচ্ছি বিলুপ্তির অন্ধকারে!!!আমরা কি পারিনা আমাদের আশেপাশের জলাগুলোকে রক্ষা করতে আরো একটু দায়িত্ববান হতে? শুধুমাত্র নিজেদের আরাম, স্বাচ্ছন্দ্যবোধের কথা না ভেবে পরিবেশের কথা একটু ভাবতে?যে মাছগুলো পুষে আমার মতো আরও অনেকের হবি শুরু হয়েছে তাদের ন্যাচারাল হ্যাবিট্যাট বাঁচিয়ে রাখতে এই আবেদন রইল সমস্ত হবিস্ট পরিবারের কাছে……