
Hemichromis frempongi
পাঁচ ফোঁটা রত্নের সন্ধানে
সকাল থেকে অবিরাম ছুটে চলেছে লোকটা, গভীর অরণ্যের আদ্র পরিবেশে গায়ের ঘাম জুড়োবার ফুরসত পাচ্ছে না। সেই কখন চেনা এলাকা ছেড়েছে। এবার যেন একটু একটু করে ক্লান্তি ভর করছে ওর শরীরে। অবশ্য এরকম খাটুনি করতে ভালোমতোই অভ্যস্ত ওর পেশীবহুল শরীরটা। এ তো আর কলার ক্ষেতে কাজ করা নয়, যেমনটা ওদের গ্রামের বেশিরভাগ লোকজনই করে থাকে। ওর নাম আকোরা বোম্পে, শিকার করাটাই ওর পেশা। হ্যাঁ ছেলেবেলায় মাঝেমধ্যে কলার ক্ষেতে কাজ করেছে বটে। কিন্তু বাবার থেকে শেখা এই শিকার বিদ্যেটাই ওর আসল পেশা। আকোরা জাতিতে ওশান্তি, ওদের ছোট্ট গ্রাম আসামানে শিকারী হিসেবে ওর বেশ নামডাক। গ্রামের বয়স্করাও আজকাল বলে, হ্যাঁ আকোরা জঙ্গলটা চেনে! আর চেনে বলেই কিনা জঙ্গলের মধ্যে দিয়ে হরিণটার পেছনে এতটা দৌড়োনোর সাহস পেয়েছে! জঙ্গল তো আর সামান্য নয়, ওশান্তি মানুষজনরা সাধারণত এই ঘন সবুজ বর্ষাবনকে এড়িয়েই চলে। কিন্তু আকোরার আজ মাথায় খুন চেপেছে। ওই একফোঁটা হরিণ, যাকে ওরা আদোয়া বলে সে কিনা আকোরা বোম্পের হাত ফস্কে পালাবে! না এ হতে দেওয়া যায় না! আশার কথা ব্যাটা হরিণ জখম হয়েছে। একবার যখন আকোরার ধনুক থেকে বেরোনো তীর ছোট্ট হরিণটাকে ছুঁতে পেরেছে তখন সে শিকার নিয়েই গ্রামে ফিরবে। আর এই নেশাতেই নিজের চেনা জঙ্গল থেকে বেরিয়ে এই ঘন বর্ষাবনের মধ্যে দিয়ে হরিণটাকে ধাওয়া করেছে আকোরা। আর ওই পুচকে হরিণটাও এই ঝোপ থেকে ওই ঝোপ ছুটে চলেছে অবিরাম।
কিন্তু এবার থমকে গেছে ও। থমকে গেছে ভূ-ভাগের হঠাৎ পরিবর্তনে। এরকম তো আগে দেখেনি। জঙ্গলটাকে এরকম মাটির মধ্যে ঢুকিয়ে দিয়েছে কে? ঠিক যেন হাতের চাপে একটা বিশাল গর্ত তৈরি করেছে এই পৃথিবী যার সৃষ্টি, সেই দেবী আসাসে-ইয়া। কই আসামানের জ্ঞানীগুণী বুড়োগুলোও তো কোনোদিন এই জায়গার কথা বলেনি। সাহস সঞ্চয় করে বিশাল সেই গর্তের ঢালু পাড় ধরে নিচের দিকে নামতে থাকে আকোরা। হরিণটাকে এদিকপানেই আসতে দেখেছে। চারিদিকে প্রাচীন সব মহীরুহ, কি তাদের উচ্চতা দেখলেই শ্রদ্ধায় মাথা নুইয়ে আসে। সেসবের মধ্যে আরো দিয়ে নিচের দিকে নামতে থাকে আকোরা। এসে পৌঁছোয় একটা হ্রদের ধারে। সেখানেই নিশ্চিন্তে দাঁড়িয়ে আছে ছোট্ট হরিণটা, আস্তে আস্তে সে মিলিয়ে গেল হ্রদের ধার বরাবর হয়ে থাকা ঘাসের জঙ্গলে। নাকি ওই হ্রদটাই শিকারীর হাত থেকে বাঁচাতে নিরাপদ আশ্রয় দিল হরিণটাকে!
বিস্ময়ে হতবাক হয়ে বসে পড়ে আকোরা বোম্পে। বিশাল বর্ষাবনের মধ্যে লুকিয়ে থাকা দেবতার এ কোন লীলাভূমিতে এসে পড়েছে সে। এতো বড় সাধারণ জায়গা নয়। হ্রদের একটা নামও অস্ফুটে বেরিয়ে আসে আকারার মুখ থেকে “বোসুম্তি”। হরিণের দেবতা। ততক্ষণে সিদ্ধান্ত নিয়ে নিয়েছে সে, বাকি জীবনটা কাটিয়ে দেবে এই বোসুম্তি হ্রদের ধারে। আসামান গ্রামের বাকি ওশান্তি ভাইদেরও বলবে এ দেবভূমির কথা।
এরপর কেটে গেছে দীর্ঘ সাড়ে তিনশো বছর। দক্ষিণ ঘানার লেক বোসুম্তিকে কেন্দ্র করেই গড়ে উঠেছে ওশান্তি উপজাতির সভ্যতা সংস্কৃতি। তাদের নামানুসারেই গোটা এলাকার নাম হয়েছে “ওশান্তি রিজিওন”, ঘানার ষোলোটি রাজনৈতিক অঞলের মধ্যে দ্বিতীয় বৃহত্তম।
ইতিমধ্যে বিজ্ঞান অনেক অগ্রগতি করেছে। আধুনিক গবেষণায় জানা গেছে আনুমানিক দশ লক্ষ বছর আগে এক উল্কাপাতের ফলে ভূপৃষ্ঠে এক বিশাল, 10 কিমি ব্যাসের গর্ত (impact crater) তৈরি হয়। আর তাতেই বৃষ্টির জল জমে প্রায় 49 স্কোয়ার কিমি জায়গা জুড়ে লেক বোসুম্তির সৃষ্টি। তবে বসুম্তি লেক আজও রয়ে গেছে তার যাবতীয় মহিমা নিয়ে। আজও ওশান্তি জনজাতির মানুষরা বিশ্বাস করে মানুষের আত্মা ইহলোক ত্যাগের আগে এখানেই শেষ বিদায় জানায় দেবী আসাসে-ইয়া কে। কিছুদিন আগেও ওশান্তি জনজাতির লোকজন পবিত্র বোসুম্তি লেকে নৌকা নামাতো না। কাঠের পাটাতনে চড়ে মাছ ধরতো। যদিও “আধুনিকতা”র ছোঁয়ায় পালটে গেছে অনেক বিশ্বাস। আজ বোসু্ম্তি লেকের ধারে গড়ে উঠেছে রিসর্ট, ছুটি কাটাতে আসা মানুষরা প্রমোদতরীতে সান্ধ্য ভ্রমণ করে লেকের জলে।
কিন্তু আকোরা বোম্পের গল্পকে মান্যতা দিয়ে গবেষকরা বলেন, চিরকাল এমন ছিল না বোসুম্তির চেহারা। বরং লেক ছিল গর্তের অনেক নিচে, ছোট পুকুরের মতো, বিশাল বিশাল বৃক্ষরাজি ঢেকে রাখতো ক্রেটারের বেশিরভাগ অংশ। বরং জল টলটলে লেকের চেহারা হালে হয়েছে। আজও কোথাও কোথাও লেকের জল থেকে মাথা তুলে থাকা শতাধিক বছরের প্রাচীন বৃক্ষের দেহাবশেষ সেই সাক্ষ্যই বহন করে।
এবার আসি বোসুম্তি হ্রদের মাছের গল্পে। কোনোরকম নদী থেকে বিচ্ছিন্ন বোসুম্তি হ্রদ আর সেখানে বৃষ্টির জল বয়ে আনা ছোট বড় মিলে প্রায় সাঁইত্রিশটি জলধারা ধরলেও কিন্তু এখানকার মৎস্যবৈচিত্র একরকম হাতেগোনা। মেরেকেটে মোট এগারো প্রজাতির মাছের দেখা মেলে হ্রদের জলে, এদের মধ্যে পাঁচটি সিকলিড পরিবারের। যাদের মধ্যে একটিকে প্রথম বর্ণনা করেন প্রখ্যাত অ্যাকোয়ারিস্ট এবং সিকলিড বিশেষজ্ঞ Dr. Paul V. Loiselle, নাম রাখেন ঘানার মৎস্যবিজ্ঞানী Emmanuel Frempong এর নামে, Hemichromis frempongi. শুরুতে মনে করা হত H. frempongi লেক বোসুম্তির এনডেমিক প্রজাতি, মানে সারা বিশ্বে আর কোথাও এর দেখা মেলেনা। যদিও সেই ভুল এখন ভেঙেছে। frempongi কে আলাদা স্পিসিজ হিসেবে না দেখে, এখন একে Hemichromis fasciatus এর লোকাল ভ্যারিয়েশন হিসেবে দেখা হয়; যাদের দেখা মেলে পশ্চিম আফ্রিকার বিস্তীর্ণ অঞ্চল জুড়ে। কাছাকাছি চেনা প্রজাতি বলতে রেড জুয়েল ফিশ। Hemichromis জেনাসটা আসলে আগাগোড়া জুয়েলদের জন্যই বরাদ্দ। ইনি কিন্তু রেড জুয়েলদের মতো আগাগোড়া লাল নন। এনার রঙ হলদেটে জলপাই, কিছুটা লম্বাটে চেহারা, বয়সের সাথে সাথে গলা থেকে পেটে উজ্জ্বল লাল রঙ ধরে আর লেজ থেকে বুক পাখনা পর্যন্ত প্রায় সমদূরত্বে পাঁচটা কালো ফোঁটা। ইংরেজি নামও তাই “ফাইভ-স্পট জুয়েল”। পূর্ণাঙ্গ ফ্রেমপোঙ্গি ছয় ইঞ্চির কম হলেও অ্যাগ্রেশনে অনেক বাঘা বাঘা মাছকে হার মানায়। তাই অ্যাকোয়ারিয়ামে রাখতে হলে একজোড়ার জন্য অন্তত চারফুটের অ্যাকোয়ারিয়াম আবশ্যিক। মোটামুটি নিউট্রাল pH এর জল এদের পছন্দের, জলে ঢুবে থাকা মরা গাছের গুঁড়ি, শেকড়বাকড়ের খাঁজে-খোঁজে ঘুরতে ভালোবাসে ফ্রেমপোঙ্গি, তাই অ্যাকোয়ারিয়ামের ডেকরেশনও হতে হবে সেইমতন।
প্রাকৃতিক পরিবেশে এদের পছন্দের মেনুর বেশিটাই পূরণ করে ছোট মাছ আর বিভিন্ন জলের পোকামাকড়। অ্যাকোয়ারিয়ামেও খাবার দাবার নিয়ে এদের তেমন সমস্যা নেই, নানারকম ড্রাই ফুডে সহজেই এদের অভ্যস্ত করা যায়।
বোসুম্তির পাঁচ প্রজাতির সিকলিডের মধ্যে দুই প্রজাতি মাউথ ব্রুডার, মানে মা জন্ম থেকে বাচ্চাকে বড় করে নিজেদের মুখের মধ্যে রেখে। আর বাকি তিনটি সাবস্ট্রেট স্পনার। আমাদের লালপেট ফ্রেমপোঙ্গি এই দ্বিতীয় দলের সদস্য। শুকনো ডালপালার আলোছায়ায় এরা সঙ্গীর সাথে জোড় বাধে। সাবস্ট্রেটে অগভীর গর্ত করে ডিম পাড়ে। বাচ্চাকাচ্চার দেখভালের দায়িত্বভার বাবা-মা দুজনেই ভাগাভাগি করে সামলায়। পছন্দসই সঙ্গী আর যথাযথ পরিবেশ পেলে অ্যাকোয়ারিয়ামে সহজেই ছানাপোনা দেয় ফ্রেমপোঙ্গি।
কাঁচবাক্সে ফ্রেমপোঙ্গি রাখলে জলের ঊষ্ণতার খেয়াল রাখা অবশ্যকর্তব্য। এদের আবাসভূমি নিরক্ষীয় অঞ্চলে হওয়ায় সারা বছর জলের তাপমাত্রা মোটামুটি 24°- 28° সেলসিয়াসের মধ্যে ঘোরাফেরা করে। তাই হঠাৎই টেম্পারেচার পড়ে গেলেই এদের যথেষ্ট ধকল সহ্য করতে হয়। সেটা যে শুধুই শীতকালে তা নয়, হঠাৎ ঝড় বৃষ্টিতে পারদ নেমে যাওয়াটাও এদের না পসন্দ। তাই ফ্রেমপোঙ্গি করতে হলে থার্মোস্ট্যাট একরকম বাধ্যতামূলক।
আর যে জিনিসটা খেয়াল রেখে চলতে হয় জুয়েল গ্রুপের মাছ করতে হলে সেটা হল এদের মেজাজ। স্পিসিজ অনলি ট্যাঙ্কই প্রথম পছন্দ হওয়া উচিত সফলভাবে ফ্রেমপোঙ্গি করতে চাইলে। অন্য প্রজাতির দ্বিগুণ সাইজের মাছকেও ধুনে দেওয়া এদের জন্য ভীষণ স্বাভাবিক একটা ব্যাপার। তাই বড় ট্যাঙ্কে একজোড়া, বা খুব বড়ো ট্যাঙ্কে দুইজোড়া ফ্রেমপোঙ্গি করলে তবেই পুরো নম্বর পাবার সম্ভাবনা।
কিন্তু ফ্রেমপোঙ্গির আবাসভূমি লেক বোসুম্তি আজ ভালো নেই। ক্রমাগত বাড়তে থাকা মানুষজনের চাপে আজ কিছুটা সমস্যায় হ্রদের জীববৈচিত্র্য। তিরিশটা গ্রামের প্রায় সত্তর হাজারের কাছাকাছি মানুষের বাস লেকের আসেপাশে। যাদের প্রধান জীবিকা চাষবাস আর মাছধরা। আর এই সমস্থ মানুষজনের জীবনধারণ হ্রদের ওপর এতটাই নির্ভরশীল যে UNESCO লেক বোসুম্তিকে স্বীকৃতি দিয়েছে বায়োস্ফিয়ার রিজার্ভের। অনেকটা আমাদের সুন্দরবনের মতো। কিন্তু লেকের আসপাশে ক্রমবর্ধমান কোকো চাষের ফার্ম থেকে লেকের জলে মেশা রাসায়নিক কীটনাশকে, লেকের আসপাশের জঙ্গলে অবাধ পশুচারণে শঙ্কায় বায়োস্ফিয়ার রিজার্ভের জীবকূল। লেকের আসপাশে গড়ে ওঠা একের পর এক রিসর্ট হয়তো ওশান্তি লোকজনের কিছুটা কর্মসংস্থান করেছে, দিয়েছে আর্থিক স্বচ্ছলতা। কিন্তু লেকের ক্যাচমেন্ট এরিয়ায় ভূমিক্ষয় বেড়ে গেছে অনেকটাই। অতিরিক্ত মাছধরা আরেক সমস্যা। যে অফুরান মৎস্য সম্পদ একসময় ওশান্তি জনজাতিকে উৎসাহিত করেছিল লেকের পাশে বসতি স্থাপন করতে, সেই ভাঁড়ারে আজ টান পড়েছে। চোখে পড়ার মতো কমে গেছে লেক বোসুম্তির মাছ। আশার কথা আঞ্চলিক তথা ঘানার প্রশাসন সমস্যাটা অনুধাবন করেছে এবং সমস্যার সমাধান করতে সচেষ্ট হয়েছে। শুরু হয়েছে বোসুমতির ক্যাচমেন্ট এরিয়ায় নতুন করে বৃক্ষরোপণ। সক্রিয় অংশগ্রহণ করছে ওশান্তি মানুষজনও।
আশা করাই যায় শুধুমাত্র কাঁচের বাক্সেই নয় লাল পেটের ফ্রেমপোঙ্গিরা বেঁচে থাকবে তাদের নিজস্ব অনন্য আবাসভূমিতে। ওশান্তি মানুষজন আরো কয়েকশো বছর ধরে শোনাবে লেক বোসুম্তি আর আকোরা বোম্পের গল্প।
References :




ওশান্তি জনজাতির মাছ ধরার চিরাচরিত পদ্ধতি লেক বোসুম্তির নয়নাভিরাম প্রাকৃতি লেক বোসুম্তির নয়নাভিরাম প্রাকৃতি ফ্রেমপোঙ্গির মনমতো আস্তানা।