Breeding of Aquarium fish
রঙিন মাছের প্রজনন পদ্ধতি (প্রথম পর্ব)
পৃথিবীর লক্ষ লক্ষ নদী-পুকুর-জলাশয়ে হাজার হাজার প্রজাতির মাছের বসবাস। তাদের যেমন আলাদা আলাদা পরিবেশ, তেমনি আলাদা আলাদা প্রজননের রীতি। যাদের আমরা অ্যাকোয়ারিয়ামে রেখে গৃহপালিত করে ফেলেছি, তারাও হাজারো বছরের বিবর্তনের মাধ্যমে রপ্ত করেছে কিছু নির্দিষ্ট প্রজনন রীতি। আবার বর্তমানে বানিজ্যিক ভাবে মৎস্যচাষ শুরু হওয়ায়, মানুষ কৃত্রিম উপায়ে বৈজ্ঞানিক পদ্ধতি অবলম্বন করে সৃষ্টি করেছে নতুন নতুন প্রজনন রীতির। সেই সব প্রাকৃতিক ও কৃত্রিম পদ্ধতি গুলো নিয়েই দুই পর্বে আলোচনা করা হবে, আজ প্রথম পর্ব প্রাকৃতিক_পদ্ধতি :
নির্দিষ্ট পরিবেশে নির্দিষ্ট সমকাল ধরে বসবাসকারী মাছেরা নিজেদের বিবর্তন ঘটিয়ে এই পদ্ধতি গুলি উদ্ভাবন করেছে। যথাক্রমে …
ক) সরাসরি বাচ্চা প্রসবকারী মাছ (Live bearer fish) :
যে সকল পরিবেশে মাছেরা ডিম পাড়লে ডিম সুরক্ষিত নয়, অর্থাৎ নিজ প্রজাতির বা অন্যান্য প্রজাতির মাছেদের পেটে চলে যাওয়ার সম্ভাবনা আছে সেখানে মাছেরা ডিম না পেড়ে সরাসরি বাচ্চা প্রসব করে। এক্ষেত্রে পুরুষ মাছের শুক্রানু দ্বারা স্ত্রী মাছের ডিম স্ত্রী মাছের দেহের ভিতরেই নিষিক্ত হয়, বাচ্চা সেখানেই পরিনত হতে থাকে, এবং সম্পূর্ণ পরিনত হলে স্ত্রী মাছ সরাসরি বাচ্চা প্রসব করে। মলি, গাম্প, প্লাটি, সোর্ডটেল ইত্যাদি আমাদের অতি পরিচিত Live bearers.
খ) ডিম পাড়া মাছ (Egg laying fishes) :
পৃথিবীর বেশিরভাগ মাছই এই শ্রেণীতে পড়ে। তবে ডিম পাড়ার রীতি অনুযায়ী এদের আবার কতগুলো ভাগে ভাগ করা যায়, যেমন ..
(১) Egg Scatters (ডিম ছড়িয়ে দেয় যারা) :
মাছের জগতে বিবর্তনের দিক দিয়ে তুলনায় যারা অনেক নিচের সারিতে অবস্থান করছে এবং যাদের বাচ্চার সংখ্যা বেশি ও বাচ্চাদের প্রতি আপত্য স্নেহ কম সেই ধরনের মাছেরা ডিম ছড়িয়ে প্রজনন কার্য সম্পাদন করে। সাধারণত প্রজনন মৌসুমে উপযুক্ত পরিবেশে স্ত্রী মাছ ও পুরুষ মাছ একসাথে মিলিত হয় এবং একসাথে ডিম ও শুক্রানু ত্যাগ করতে থাকে। এরপর নিষিক্ত ডিম স্রোতের টানে বহুদূর ভেসে যায়। সাধারণত এদের ডিমে আঠালো ভাব কম থাকে বা একেবারেই থাকে না। যার ফলে ভেসে যাওয়া ডিম ভাসতে ভাসতে যেখানে পৌঁছায় ওখানেই চারা উৎপাদিত হয় এবং চারাগুলি একা একাই বড় হতে থাকে।
মেজর ও মাইনর কার্প জাতীয় মাছ, বার্ব, ড্যানিও ইত্যাদি মাছেরা এই শ্রেণীতে পড়ে।
(২) Egg depositors (ডিম প্রতিস্থাপনকারী) :
সাধারণত যে সব মাছ নিজেদের ডিম ও বাচ্চার প্রতি যত্নশীল হয়, এবং বিবর্তনের ধারায় কিছুটা উপরের দিকে অবস্থিত তারাই এই পদ্ধতিতে ডিম পাড়ে। সাধারণত কোন শক্ত পাথর বা কাঠের গুঁড়ি জাতীয় অংশে স্ত্রী মাছ ডিম পাড়ে, পুরুষ মাছেরা সেই ডিমকে নিষিক্ত করে। এবং উভয় মাছ একসাথে ডিম পাহারা দেয়। পরবর্তীতে ডিম ফুটে বাচ্চা বের হয়ে গেলেও একটা নির্দিষ্ট বয়স পর্যন্ত পুরুষ ও স্ত্রী মাছ একসাথে বাচ্চাদের রক্ষা করে। এই সব মাছেদের ডিম চটচটে আঠালো হওয়ায়, ডিম পাড়ার সাথে সাথেই সেটা কাঠ বা পাথরের টুকরোর সাথে লেগে যায়, এবং স্রোতের টানে বয়ে যায় না।
দক্ষিণ ও মধ্য আমেরিকার সিকলিড প্রজাতির মাছেরা, আমাদের দেশের চ্যাঙ-শোল প্রভৃতি মাছ এই শ্রেণীতে অবস্থান করে।
(৩) Nest builders (বসা তৈরি করে যারা) :
হ্যাঁ ঠিকই শুনছেন, মাছেও বাসা তৈরি করে, এবং সেখানে ডিম দেয়, বাচ্চা প্রতিপালন করে। এবং এক্ষেত্রেও বাসা তৈরি থেকে বাচ্চা বড় করা পর্যন্ত সিংহভাগ দায়িত্ব পুরুষ মাছেরাই পালন করে। সাধারণত দক্ষিণ পূর্ব এশিয়ার গোরামি প্রজাতির মাছে, আফ্রিকার সিকলিড, দক্ষিণ আমেরিকার প্লেকোরা এই শ্রেণীতে পড়ে। প্লেকোরা ও সিকলিডরা মাটি খুঁড়ে বাসা বানিয়ে স্ত্রী মাছকে আকৃষ্ট করার জন্য বসে থাকে, অন্যদিকে গোরামিরা জলজ গাছপালার দামের মধ্যে “বাবল নেস্ট” বানায়। সাধারণত বাতাস মুখের লালার সাথে মিশিয়ে এই ধরনের বাসা তারা তৈরি করে। সেখানে স্ত্রী মাছের সাথে মিলনের পর পুরুষ মাছ ডিম গুঁজে রাখে। এরপর ডিম ফুটে বাচ্চা বের হওয়া পর্যন্ত পুরুষ মাছ ডিম পাহারা দেয়। কিছু আমেরিকান ক্যাটফিস, আমাদের দেশের চিতল প্রভৃতি মাছেরও বাসা বেঁধে ডিম পাড়ার অভ্যাস আছে।
(৪) অন্যান্য পদ্ধতি :
[ i ] অন্যান্য চমকপ্রদ পদ্ধতির মধ্যে যাঁদের নাম সবার আগে আসবে তাঁরা হল মালাউই সিকলিড গোষ্ঠী, তিলাপিয়া গোষ্ঠী প্রভৃতি। এরা যে শুধুমাত্র বাসা বানিয়ে ডিম পাড়ে তাই নয়, বরং ডিম পাড়ার পর স্ত্রী মাছ ডিমগুলি চটজলদি মুখের ভিতর ঢুকিয়ে নেয়। এবং সেখানেই তা দিতে থাকে। ডিম ফুটে বাচ্চা বের হয়ে গেলেও মা তাদের হানাদারদের থেকে রক্ষা করতে নিজেদের মুখেই রাখে। এরপর নিজেরা স্বাবলম্বী হলে তবেই মা তাদের প্রকৃতিতে ছাড়ে। এই পুরো পর্যায়ে মা মাছ এক থেকে দেড় মাস পর্যন্ত কোন খাওয়া দাওয়া না করে নিজের বাচ্চা প্রতিপালন করে । পৃথিবীতে বাচ্চাদের জন্য মায়েদের এরকম আত্মত্যাগের উদাহরণ খুব বেশি নেই।
[ ii ] আফ্রিকার কিলিফিশ গোষ্ঠী একবর্ষজীবি মাছ, অর্থাৎ এরা এমন জায়গায় বসবাস করে যেখানে বর্ষাকালের নতুন জলে এদের ডিম ফুটে বাচ্চা বের হয়, এবং বর্ষার জল শুকিয়ে যাওয়ার আগেই সেই বাচ্চারা বড় হয়ে ডিম পেড়ে মরেও যায়। তাহলে এখন প্রশ্ন হচ্ছে ঐ ডিমগুলোর তাহলে কি হয়? মাছগুলি মারা যাওয়ার আগে ডিমগুলিকে কাদামাটিতে এমন ভাবে সংরক্ষণ করে যায় যাতে পরের বছর বর্ষার জল পেলে আবার তা থেকে ছানাপোনা বের হয়।
[ iii ] ডিম পাড়তে হাজার হাজার মাইল অতিক্রম করে আসছে, এমন মাছেরাও কিন্তু প্রকৃতিতে আছে, ইংরাজি ভাষায় যাদের আমরা মাইগ্রেটরি ফিশেস বলে ডাকি, আটলান্টিক স্যামন, রেড চেরি স্যামন, ইলিশ, ঈল প্রভৃতি মাছ এদের উদাহরণ। এদের কেউ কেউ সারাজীবন সমুদ্রে বসবাস করে কিন্তু ডিম পাড়ার সময় হলেই নদীতে ফিরে আসে। বা উল্টোটা করে, সেক্ষেত্রে নদীর মাছ সমুদ্রে ফিরে যায় । এই সব মাছেদের বিজ্ঞানীরা দুটি শ্রেণীতে ফেলেছেন যথা –
• অ্যানাড্রোমাস : যারা সমুদ্রে বসবাস করে কিন্তু ডিম পাড়তে মিষ্টি জলে ফিরে আসে।
• ক্যাটাড্রোমাস : যারা মিষ্টি জলে বসবাস করে কিন্তু ডিম পাড়তে নোনা জলে ফিরে আসে।
[ iv] Splash tetra (Copella Arnoldi) এমন একটি ছোট্ট মাছ যাঁরা জলে বসবাস করে ডাঙায় ডিম পাড়ে। আমাজন ও অরনোকো নদীতে বসবাসকারী এই মাছটি এই আশ্চর্যজনক আচরণের কারণ হলো হিংস্র মাছেদের থেকে নিজেদের পরবর্তী প্রজন্মকে রক্ষা। সাধারণত জলের কাছাকাছি কোন গাছের পাতায় পুরুষ ও স্ত্রী মাছ একসাথে ডিম পাড়ে, এবং লেজ দিয়ে জলের ছিটা দিয়ে ডিমগুলি সতেজ রাখে (এই কারণেই এদের নাম হয়েছে Splash tetra) । তারপর ডিম ফুটে বাচ্চা বের হয়ে আস্তে আস্তে নদীতে এসে পড়ে ।
এই পর্যন্ত পড়ে যদি ভাবেন সব শেষ, তা কিন্তু মোটেই নয়, আরো অনেক অনেক চমকপ্রদ প্রজনন আচরণ প্রকৃতিতে প্রতিনিয়ত ঘটে চলেছে, আমরা তার কতটুকুই বা জানতে পেরেছি, সবটুকুর মাঝে কিছুটা জানতে চাই নিবিড় প্রকৃতি পর্যবেক্ষণ ও তার অভিজ্ঞতা শেয়ার, সেজন্য আমাদের গ্রুপের কমেন্ট সেকসন পাঠকদের জন্য উন্মুক্ত রইল …