Anabas testudineus(The Climbing Perch )
কইমাছ
আষাঢ় মাসের শেষ, অম্বুবাচীর ভোর, তিনদিন ধরে অঝোরে বৃষ্টি চলছে, আধা শহরটির পুকুর-নদী, খাল-বিল এখন থৈ থৈ। এরমধ্যেই এক কিশোর এক হাতে ছাতা, এক হাতে কোচ নিয়ে এক এঁদো পুকুর ধারে বাঁশ বাগানের নীচে চুপচাপ বসে, যে নালাটা দিয়ে পুকুরে জল নামছে সেই দিকে দৃষ্টি স্থির। মাঝে মাঝে কোচটা নালায় ছুঁড়ছে, আর যে মাছ পাচ্ছে কোমড়ের ঘুমসিতে বাঁধা থলেতে ভরছে। নব্বই দশকের শুরুর দিকের এই খুব সাধারণ ভোরটি আজ অনেকের কাছে রূপকথার মতো শোনাবে ঠিকই, তবুও যাবতীয় বাধাবিপত্তি জয় করে এখনো যে কয়টি দেশি মাছ এখনো রূপকথার মতো এদেশে বহাল তবিয়তে টিকে আছে, কই মাছ তাদের মধ্যে একটি। আজ তাই ওদের নিয়েই না হয় কথা বলি … দই কই, সর্ষেবাটা দিয়ে ঝাল ইত্যাদি ছাড়া এই দেশি মাছটির গুরুত্ব আমরা সেভাবে দিই না ঠিকই, কিন্তু রঙিন মাছের বাজারে এই মাছটির গুরুত্ব ক্রমেই কিন্তু বেড়ে চলেছে। চনমনে, কষ্টসহিষ্ণু, কিউট দেখতে এই মাছটি অনেক বায়োটোপ অ্যাকোয়ারিস্টের পছন্দের তালিকায় থাকছে । সেইসব চিন্তা করেই একদিন দুম করে বাজার থেকে চাট্টি কইমাছ কিনে একটা খালি ট্যাঙ্কে রেখেই দিলাম। অনেকটা দেখি কি হয় টাইপের ব্যপার।যাইহোক দেখতে গিয়ে কি দেখলাম সেটাই এবার বলি , কই একটি হিংসুটে, কুচুটে, নিশাচর, মারামারিবাজ মাছ যাঁরা দিনে লুকিয়ে থাকে, রাতে adventure ভালোবাসে। দিনের বেলায় সাধারণত জলজ গাছপালা, কাঠের গুঁড়ি, ইত্যাদির নিচে ঢুকে বিশ্রাম নেয় । এবং বিশ্রামের জায়গা দখল নিয়ে নিজেদের মধ্যে বিস্তর ঝামেলা হয়, এক জায়গায় অনেক মাছ ঠাসাঠাসি করে থাকে, বড় গুলো গায়ের জোরে জায়গা দখল করে নিলে, ছোটগুলো ইতিউতি চান্স পাওয়ার আশায় ঘুরতে থাকে। যখনই কেউ একটুও জায়গা ছেড়ে নড়ে সুরুৎ করে সেখানে ঢুকে পড়ে। রাত হলেই এরা নিজেদের রূপ বদলে ফেলে বিশ্রামের জায়গা ছেড়ে একা একা শিকারের খোঁজে বেড়িয়ে পড়ে, ছোটখাটো পোকামাকড়, কেঁচো, অমেরুদণ্ডী প্রাণী দেখলে ঝাঁপিয়ে পড়ে। যেখানে একটি মাছ খাবার খুঁজে পায় সেখানে তৎক্ষণাৎ আরও অনেক মাছ ছুটে আসে। যেহেতু কই মাছ Air breather তাই এরা মাঝে মাঝে জল ঝটিতি উপরে উঠে আবার গভীর জলে নেমে আসে। এক্ষেত্রে খেয়াল করলে দেখা যাবে (বিশেষত দিনের বেলা) এদের জলের নিচ থেকে উপরে উঠে বাতাস থেকে অক্সিজেন নিয়ে নীচে ফিরে আসার কাজটি কতগুলো পর্যায়ে সম্পূর্ণ করে যথাক্রমে , ১) দ্রুত জলের নিচ থেকে সারফেসের অনেকটা কাছে উঠে আসা, ২) উঠে এসে জলজ দামের কাছে থামা, ৩) সেখান থেকে টুক দ্রুত বাতাস নেওয়া, ৪) বাতাস নিয়েই দ্রুত জলজ দামের নীচে লুকানো, ৫) জলজ দামের নীচ থেকে ধীরে ধীরে গভীরে চলে যাওয়া।তবে দিনের বেলা এই পর্যায়গুলো কমবেশি মেনে চললেও, রাতে এরা নির্ভয়ে উপরে উঠে আসে এবং জলের উপরিতলে ঘোরাফেরা করে নিজেদের ইচ্ছা মতো ধীরে-সুস্থে বাতাস নেয়। অনেক সময় উঠতি বয়সের কই চ্যাংড়া কই-রা নিরাপত্তাহীনতায় ভুগে একা একা বাতাস নিতে ভয় পায়, এবং দলবদ্ধভাবে দ্রুত পরপর কাজটি করে, সেজন্যেই মাঝে মাঝে পুকুরে একসাথে অনেক কই-এর ঘাই মারতে (বাতাস থেকে মাছের অক্সিজেন নেওয়ার গ্রাম্য পরিভাষা) দেখা যায়। কই মাছ স্বাধীনতা পছন্দ করলেও জীবনের দুটি ক্ষেত্রে দলবদ্ধ ভাবে চলাফেরা করে, প্রথমতঃ ছোটবেলায় বাচ্চা কইরা নিরাপত্তার স্বার্থে ঝাঁক বেঁধে ঘোরাফেরা করে, বয়স বাড়ার সাথে সাথে ঝাঁকের বাঁধন খুলে পড়ে, দ্বিতীয়ত, প্রজনন মৌসুমে অর্থাৎ বর্ষার প্রথমদিকে স্ত্রী মাছ নিজের পুরোনো এঁদো কম অক্সিজেন যুক্ত বাসস্থান ছেড়ে নতুন অক্সিজেন যুক্ত, নির্মল জলের সন্ধানে বের হয়, সেক্ষেত্রে সে কানকোর সাহায্যে ডাঙায় হেঁটে হেঁটে নতুন কোন জলা, ধানক্ষেত ইত্যাদিতে পৌঁছানোর চেষ্টা করে। তখন পুরুষ মাছেরা দলবদ্ধভাবে আদিম রিপুর তাড়নায় স্ত্রী মাছটিকে ধাওয়া করে। স্ত্রী মাছ সাধারণত পুরুষ মাছের চেয়ে আকারে বড় মোটাসোটা হয়, পুরুষ মাছ সাধারণত লম্বাটে সরু আকৃতির হয়। পরিনত বয়সে ও প্রজনন মৌসুমে স্ত্রী-পুরুষ মাছের দেহের উপরিভাগ কালচে এবং পেটের নীচে গাঢ় হলুদ বর্ণ ধারণ করে। বাচ্চা মাছের পেট সাদাটে ও গায়ের রং সবুজাভ থাকে।বাচ্চা হোক বা বড় উভয় মাছই একটি অসাধারণ “অ্যাকোয়ারিয়াম ফিশ” যাঁরা সারাদিন চনমনে থেকে আপনার কাঁচের বাক্স মাতিয়ে দেবে, বছরের বেশিরভাগ সময় এঁদো পুকুরে থাকে বলে এরা সহজেই ব্ল্যাক ওয়াটার ট্যাঙ্কে মানিয়ে নিতে পারে, আবার পরিস্কার জলেও সমান স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করে। অ্যাকোয়ারিয়ামে প্রচুর কাঠের গুঁড়ি, ডালপালা ও কিছু ভাসমান গাছপালা দিলে এদের আচার-আচরণ ভালোভাবে বেড়িয়ে আসে। তবে এরা জলের ফ্লো খুব বেশি পছন্দ করে না, এবং রাতে চড়ে বেড়াতে পছন্দ করে বলে কম স্রোতযুক্ত ফিল্টার ও বড় ট্যাঙ্ক খুব প্রয়োজনীয়। খাবার হিসেবে লাইভ ফুড, ড্রাইফুড এসব বাছবিচার করে না। তবে ড্রাই ফুডের জন্য অভ্যাস করিয়ে নেওয়া প্রয়োজন। সাধারণত ২০০ লিটার জলে ছটি কৈ মাছের ঝাঁক যথেষ্ট। সাথে একটু বড় সাইজের খলসে পুঁটি স্বচ্ছন্দে থাকতে পারে।আমাদের এখানে সাধারণত দুই ধরনের কই মাছ পাওয়া যায়, ক)গাঙ্গেয় কই [Anabas cobojius]খ) দক্ষিণ এশিয়ার কই [Anabas testudineus]তবে আর দেরি কেন, বাজারে যেটা পেয়ে যান, বা যেটা ধরতে পারেন পুষতে শুরু করুন, আর অভিজ্ঞতা শেয়ার করুন আমাদের সাথে …. ধন্যবাদ।