Badis badis

fishkeeping simplified

Badis badis

নীলকই বৃত্তান্ত বাড়ির পাশেই নিজেদের একটা পুকুর থাকায় খুব ছোটবেলাতেই সাঁতার শেখার পাশাপাশি আর একটা জিনিস আপনা থেকেই হয়েছিল। বিভিন্ন প্রজাতির দেশি মাছের সাথে মোলাকাত!!! নতুন মাছ দেখার আগ্রহটা বরাবরই ছিল, পরে সেটা ভালবাসায় দাঁড়ায়। কিন্তু খাবার পাত আলো করা মাছগুলো ছাড়া বাকি মাছগুলো, যারা স্বাদে উচ্চবিত্তের সম্মান পায়না বা ততটা জনপ্রিয় নয়, যাদের তেমন নাম শোনা যায় না, তাদের প্রতি ভালোবাসার পক্ষপাতিত্ব যেন কিঞ্চিত বেশি ছিল। সেই সব মাছেদের সাথে প্রথম আলাপের স্মৃতিগুলো আজও সেই কারণে মনে থেকে গেছে। আজ সেখান থেকেই একটা গল্প বলে লেখাটা শুরু করি।বছরে এক কি দু’বার আমাদের পুকুরে জাল দেওয়া হতো। মাঝরাতে জনা কুড়ি লোক দু’তিন দলে ভাগ হয়ে বিশাল বড় জালখানা নিয়ে পুকুর উজাড় করে মাছ নিয়ে এসে উঠতো শানবাঁধানো ঘাটে। তারপর সেই মাছ বাড়ির উঠোনে ঝাড়াই বাছাই হয়ে ভোররাতে চলে যেত মাছের আড়তে। বাড়িতে খাওয়ার এবং আত্মীয় পাড়া প্রতিবেশীকে খাওয়ানোর মাছ আগেই বেছে রাখা হতো। সেইসব জালটানার দিনগুলোয় মাঝরাতে মায়ের ডাকে আধঘুম থেকে লাফিয়ে উঠে পুকুর পাড়ে দৌড়ানো আর সেখানে তখন লাইটফাইট জ্বালিয়ে চলা বিশাল কর্মযজ্ঞ দেখা, ওফঃ সে এক অন্য রকম মজা ছিল!!! সেবার উঠোনে ঝাড়াই বাছাই চলছে বিশাল প্লাস্টিক পেতে। বড় মাছ আগেই আলাদা হয়ে আড়তে চালান হয়ে গেছে। মৌরলা আর পুঁটি আলাদা হচ্ছে। ঢিপি জমে উঠছে মাছের। স্কুলে পড়া আমি ঠায় দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে এটা কিমাছ ওটা কি মাছ করে যাচ্ছি! এরকমই একটা মাছের স্তূপের ওপর প্রথমে চোখে পড়ে ইঞ্চি দুয়েকের কালচে একটা মাছ, ঠিক যেন কই মাছের ক্ষুদ্র সংস্করণ। তখনও মুখটা নড়ছে। তারমানে মরে যায়নি তখনো। মুহূর্তে তাকে মুঠোবন্দি করে দৌড় আর তাকে এনে স্নানঘরের বালতিতে ফেলা। প্রাথমিক ধাক্কা কাটিয়ে মিনিট কুড়ির মধ্যেই বাবু স্বমহিমায়। ব্যাস সেইখান থেকে সোজা আমার মাটির মেজলায়, আমার তখনকার দেশি মাছের আস্তানা। বহুদিন সে ব্যাটা বেনামী অচেনা মাছ হয়ে সেখানে ছিল৷ আজ জানি, মেজলার ওপরের পানার আস্তরণ সরালে মাঝেমধ্যে যার নীলচে পাখনার ঝলক দেখতে পেতাম তার ভালোনাম নাপতে কই, কোথাও পোদকই কি কালধুমসী নামগুলোও চালু। লাতিন নাম Badis badis।দক্ষিণ বঙ্গের মোটামুটি সর্বত্রই একসময় যথেচ্ছ দেখা মিলতো পোদকই এর। নানা রকম বাস্তুতন্ত্রে মানিয়ে নেওয়ার এক অদ্ভুত ক্ষমতা আছে এদের। বড় জলা, বিল, দীঘি, পুকুরে, ডোবাতে পাওয়া যাবে, খাল-নয়নজুলিতে পাওয়া যাবে, এমনকি বর্ষার জলে ভাসা মাঠ ধানক্ষেতেরও অন্যতম পরিচিত মাছ ছিল এই পোদকই। পূর্ণাঙ্গ অবস্থায় বড় জোর ইঞ্চি তিনেকের মাছটার পিঠ পাখনা কই মাছের মতো কাঁটাওয়ালা শক্ত নয় বরং নরম, কানকোতেও কইয়ের মতো ধারালো খাঁজ অনুপস্থিত। গায়ের রঙ ছোট অবস্থায় কালচে, সাধারণত গায়ে ছিট ছিট দাগ ছোপ থাকে। সময়ের সাথে সাথে উপযুক্ত পরিবেশ পেলে নীলচে, সবজেটে থেকে ময়ূরকণ্ঠী রঙের ছোয়া আসে। সাথে চোখ থেকে লেজের শুরু পর্যন্ত আড়াআড়ি কালো দাগ। খুব দ্রুত দেহের রঙ পরিবর্তন করতে পারায় কোথাও কোথাও Indian Chameleon Fish নামেও উল্লেখিত হয়েছে। দেখতে দেখতে এত্তগুলো বছর পেরিয়ে গেছে কিন্তু সেই Badis এর প্রতি ভালোবাসা আমার বিন্দুমাত্র কমেনি। তবে আগে যেভাবে রাখতাম, পড়াশোনার পর তাতে একটু আধটু পরিবর্তন করেছি বটে।একটা কি দু’টো Badis কে ভালোভাবে রাখার জন্য মিনিমাম দেড়ফুটের (1.5’x1’x1′) ট্যাঙ্ক প্রয়োজন। সাবস্ট্রেট নরম নদীর বালি হলে ভালো হয় সাথে চাই যথেষ্ট পরিমাণে শুকনো পাতা, যাদের ডিকম্পোজিশান সাবিস্ট্রেটটাকে আরো বেশি উপযোগী করে তুলবে। কাঠের ডালপালা দিয়ে এমন পরিবেশ তৈরি করতে হবে যাতে মাছটা বিন্দুমাত্র অস্বস্তিবোধ না করে, দু’একটা নারকেল মালা কি কাঠবাদামের খোল দিলে তো একদম সেখানে ঘরবাড়ি বানিয়ে ফেলে। এর মাঝে যদি আপনি কিছু দেশি গাছপালা, রোটালা, পানশিউলি, ভ্যালিসনেরিয়া আর কিছু পানা দিতে পারেন তো সোনায় সোহাগা। লাইট হবে হালকা উজ্জ্বলতার। ফিল্ট্রেশন খুব জোরদার না হলেও চলবে। কিন্তু মনে রাখতে হবে সঠিকভাবে সাইকেলড ট্যাঙ্কেই এদের ছাড়া উচিত৷ সাধারণত জ্যান্ত পোকামাকড়েই এদের উৎসাহ বেশি। টিউবিফেক্স বা ব্লাডওয়ার্মেই এদের আগ্রহ বেশি, যদিও সপ্তায় দু’একদিন ড্রাই ফুডসও চলতে পারে।বর্ষার শুরুতেই এদের মনে প্রেম প্রেম ভাব আসতে শুরু করে। পুরুষ পোদকই বছরের এই সময়টাতেই সবথেকে বেশি রঙিন হয়। এই সময়টা দু’টো পুরুষের রঙিন পাখনার টক্কর একটা দেখার মতো জিনিস। আর পছন্দের স্ত্রী পেলে তার সামনে পুরুষ ব্যাডিসের বর্ণিল পাখনার দেখনদারি বা বারবার নিজের গোপন ডেরায় নিয়ে যাওয়ার হাতছানি চাক্ষুষ করার নেশা ছাড়া মুশকিল! তবে বর্তমানে আমাদের দক্ষিণবঙ্গে এদের সংখ্যা অত্যন্ত দ্রুতগতিতে হ্রাস পাচ্ছে। গত দশ বছরে এই কমে যাওয়াটা চোখে পড়ার মতো৷ রাতারাতি জলাভূমি বুজিয়ে ফেলা সাথে চাষের মাঠে ব্যবহৃত নানাবিধ বিষাক্ত পেস্টিসাইড এদের দিনকে দিন দুর্লভ করে তুলেছে। গ্রামের দিকেও বেশিরভাগ পুকুরে মাছচাষ হওয়ায় আর সেখানে এদের আর পাঁচটা দেশি মাছের সাথে অবাঞ্ছিত মনে করায় সেই সব পুকুর দীঘিতেও এরা কতটা সুরক্ষিত বলা মুশকিল। সুতরাং আপনি যদি এদের পুষবেন বলে মনে করেন তবে পোষার মতো করে পুষুন, প্রায় বিনামূল্যে পেলেন বলেই অবহেলা করবেন না৷ না হলে হয়তো আমাদের পরবর্তী প্রজন্ম পোদকইয়ের নাম আমাদের মুখের গল্পেই শুনবে, তাদের পাখনার চটক আর ব্রিডিং ড্যান্স দেখার সুযোগ হয়তো আর থাকবে না!!!

We are accepting the entries for IBAC

X